সবাইকে ফাল্গুনের শুভেচ্ছা। এই ফাগুনের বাতাসে ফকীর লালন শাঁইজীও পাগল হয়েছিলেন। জানা যায় তিনি জীবিত থাকতে, ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমাতে সারা রাত ধরে গান বাজনা করতেন। ফকীর লালন শাঁইজী চলে যাবার পর কুষ্টিয়াতে পা দিলেন কবি গুরু রবী ঠাকুর। তিনিও ফাল্গুনের মাতাল হাওয়াতে ঠিক থাকতে পারেননি। তিনিও কুষ্টিয়ার পদ্মার পাড়ে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি বসে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা, গান এবং উপন্যাস। আমাদের প্রিয় কবি আজিজুর রহমান তিনিও এই ফাগুন নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন।
কুষ্টিয়াতে ফাল্গুন মাসে আলাদা একটা পরিবেশ তৈরি হয়। ফাল্গুনের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে বৃহত্তর কুষ্টিয়াতে। একটু সুযোগ পেলেই মন ছুটে চলে যেতে যায় ফাল্গুনের মোহনাতে। কুষ্টিয়াতে ফাল্গুনের মোহনা হচ্ছে গড়াই এবং পদ্মা নদীর পাড়। প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ সকাল হতে ভিড় জমাই এই সব স্থানে, চলে সন্ধ্যা অবধি। কবি গুরু রবি ঠাকুরের বাড়ি পদ্মার পাড় ঘেঁষে হওয়াতে শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে ফাল্গুন পাগল মানুষ গুলা সেখানে ভিড় জমায়। কোলাহল মুখরিত পরিবেশ ফাল্গুন মেলার উৎসবে পরিণত হয়।
বৃহত্তর কুষ্টিয়ার মানুষ সংস্কৃতি মনা, এতে কোন সন্দেহ নেই। এই দিনে গড়াই নদীর পাড়ে অনেকেই তাঁর পরিবার এবং মা-বাবাকে নিয়ে ঘুরতে আসে। অনেকেই নৌকা ভ্রমণ করে, কেওবা নদীর চরে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াই, নদীর ধারে সারি সারি কাশবন সবার নজর কাড়ে। ম্রুদু ম্রুদু বাতাস প্রাণে বিভিন্ন ধরনের স্পন্দন জাগায়। কুষ্টিয়ার পলাশ-শিমুল গাছে উচ্ছ্বাসের রং ছড়ায়।
ফাল্গুনকে বলা হয় ঋতুরাজ। বাঙালির জীবনে বসন্তের উপস্থিতি অনাদিকাল থেকেই। বসন্ত শুধু অশোক-পলাশ-শিমুলেই উচ্ছ্বাসের রং ছড়ায় না, আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্তরঙিন পুষ্পিত রক্তের স্মৃতির ওপরও রং ছড়ায়। বায়ান্ন সালের আট ফাল্গুন বা একুশের পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাধভাঙা আবেগের জোয়ার যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।
পয়লা ফাল্গুন বা পহেলা ফাল্গুন বাংলা পঞ্জিকার একাদশতম মাস ফাল্গুনের প্রথম দিন ও বসন্তের প্রথম দিন। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৩ই ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুন পালিত হয়। বসন্তকে বরণ করে নেয়ার জন্য বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশায় সহ অন্যান্য রাজ্যে দিনটি বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। বাংলাদেশে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ এই দিনকে বরণ করতে চারুকলার বকুলতলায় এবং ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবর উন্মুক্ত মঞ্চে প্রতিবছর জাতীয় বসন্ত উৎসব আয়োজন করে।
বাংলার এই অঞ্চলে, প্রাচীন আমল থেকেই বসন্ত উৎসব পালিত হচ্ছে। হিন্দুদের পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলোতে এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। হিন্দু বৈষ্ণবরা এটি বেশ আয়োজনের সাথে পালন করে থাকেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি চলে আসছে। বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব নিয়মিত আয়োজন করে আসছে।
কুষ্টিয়ার বিভিন্ন গ্রামে এই ফাল্গুন মাসকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ মেলা শুরু হয়। মেলায় পাওয়া যায় হরেক রকম গ্রামীণ খাবার, পোশাক, আসবাবপত্র এবং বাচ্চাদের মজার মজার খেলনা। এই ফাল্গুনের পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে ফকীর লালন শাঁইজীর আঁখরা বাড়িতে সপ্তাহ ব্যাপী শুরু হয় দোল পূর্ণিমা উৎসব এবং গ্রামীণ মেলা। দেশ-বিদেশ হতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে আসে এই মেলাতে অংশ নিতে। মাথার উপর পূর্ণিমার চাঁদ সারা রাত ধরে চলে আত্ন তত্তের গান। সে এক অপরূপ পরিবেশ।