বাংলা ভাষাভাষীদের অনেক ধরনের গান শুনে অভ্যস্ত। বিশেষ করে বাংলা, হিন্দি, উর্দু, আরবি, ফারসি, ইংরেজি প্রভৃতি। তবে বাংলার মানুষের প্রাণে সবার উপরে যে গান জয় করেছে, সেটা হলো বাউল গান। এক কথায় বাংলার প্রাণ বাউলের গান।
তবে কেনো এতো জনপ্রিয়তা পেলো ? বাংলার মানুষ অনেক শ্রেণীর গান শুনলেও তা বেশিদিন মনে ধরে রাখতে পারে না। কিন্তু বাউল গান সমূহ দিন যতই যাচ্ছে, দিন দিন আরো বেশী আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে সেই পুরাতন গান সমূহ। আসলে বাউল গানে রয়েছে সহজ সরল ভাবে জীবন চলার প্রেরণা। কিভাবে মানুষের চলছে বা চলবে তাঁর একটা রূপরেখা। বাউল গান সমাজের কথা বলে, বলে মানব তথা মানবতার কথা। বাউল গান বিভিন্ন তত্ত্বের উপর হয়ে থাকে।
দুই বাংলায় প্রচুর বাউল শিল্পী রয়েছে এবং উভয় বাংলার বাউলের সাথে রয়েছে অন্য রকম এক আত্নার সম্পর্ক। যা বোধহয় নিজ নিজ ধর্মের মানুষের সাথেও এমন সম্পর্ক নাই। দুই বাংলায় সমানে চলে বাউলদের বিভিন্ন গানের উৎসব। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সব বাউল বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন উৎসবে এক সাথে যোগ দেয়।
বাউলদের স্ব-ধর্ম থাকলেও তাঁরা মূলত মানব ধর্ম নিয়ে কাজ করে বেশী। কিভাবে সমাজের কল্যাণ হবে, কিভাবে মানুষের কল্যাণ হবে তাঁদের মুল ভাবের বিষয় থাকে এটা নিয়ে। তাঁরা নিজেকে মানুষ এবং সমাজের মধ্যে বিলিয়ে দেয়। এক প্রকার যাযাবরের মতো হয়ে যায়। তাঁদের থাকা কিংবা ঘুমানো নিয়ে চিন্তিত নন। আজ ফরিদপুর তো কাল নরসিংদী, আজ গোয়াহাটি তো কাল বীরভুম। আর তাঁকে ধরে রাখাও দায়। তাঁরা নিজ পরিবারের দায়িত্ব শেষ করে এই বাউল যাত্রায় যোগ দেয়। তাঁদের জীবন যে সুখের হয় ঠিক তা নয়। তারাও অনেক দুঃখ কষ্ট করেই জীবন পার করে। কিন্তু রেখে যায় কিছু মুল্যবান কথা, ধারা এবং তত্ত্ব। যা পরবর্তীতে মানুষের মনে দোলা দেয়, জানার আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে।
বাংলা উপমহাদেশে বর্তমানে সব চেয়ে বড় বাউল সাধক হচ্ছে, বাউল সম্রাট ফকীর লালন শাহ্। কিন্তু অনেকেই তাঁকে আরো উপরে বসাতে চাইছেন, কারণ হিসাবটাও অনেক বড় তিনি আরো অনেক গুনের অধিকারী ছিলেন। ফকীর লালন শাহ্ এর অনুগত তাঁর শিষ্যরাও বড় বড় বাউল এবং আজ অবধি অনেক বাউল শিল্পীর জন্ম দিয়ে যাচ্ছেন। পরবর্তীতে রয়েছেন বাউল সাধক আব্দুল করিম শাহ্। বাউল সাধক চান মিয়াঁ, বাউল সাধক জালাল উদ্দিন, বাউল সাধক হাসিম শাহ, সাধক আব্দুস সাত্তার মোহন্ত শাহ্, বাউল বশির উদ্দিন সরকার, বাউল সাধক ক্বারি আমীরউদ্দিন, বাউল সাধক কফিলউদ্দিন, বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন, বাউল সাধক দুরবিন শাহ, বাউল উমেদ আলী ফকীর, বাউল সাধক মালেক দেওয়ান,বাউল সাধক সিরাজ উদ্দিন খান পাঠান, সাধক মনমোহন দত্ত, মহান সাধক উকিল মুন্সি, পাগলা কানাই, মুকুন্দ দাস, রাধারমণ দত্ত, রজ্জব আলী দেওয়ান, বাউল শিল্পী- কবিয়াল বিজয় সরকার, বাউল আব্দুল মজিদ তালুকদার, আরো অনেক বাউল সাধক আছেন এই বাংলায়। ওপার বাংলায় নেহায়েত কম নয় অনেক গুণী গুণী বাউল সাধক রয়েছেনঃ- পবন দাস বাউল, গোলাম ফকীর, কালাচাঁদ দরবেশ, পূর্ণ দাস বাউল সম্রাট, তিনকড়ি ক্ষ্যাপা, হালিম ফকীর, চাঁদ বিবি, নিমাই গোস্বামী, বাউল জয়দেব কেন্দুলি, বসুদেব দাশ বাউল, মাকি কাজুমি, সাধন দাশ বাউল, দিপঙ্কর চক্রবর্তী, তারেখ দাস বাউল, নিতাই বাউল, গৌউর ক্ষেপা, ভোলানাথ দাস বাউল। আরো অনেক বাউল গুণী সাধক এবং শিল্পী রয়েছেন অন্য কোন লেখায় আরো বিস্তর আলোচনা করা যাবে।
বাউল গান সিনেমা, নাটক, ছোট কোন গল্প কাহিনীতে ফুটে উঠেছে। বর্তমানে বিজ্ঞাপনেও এই বাউল গানের প্রভাব বেশ লক্ষ্য করা যায়। বাউলদের নিয়ে বর্তমান সরকারও বেশ কিছু অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী তিনশোর বেশী বাউলদের গান বিভিন্নভাবে রেকর্ড করেছে এবং তা নিয়ে গবেষণা হওয়ার কথা রয়েছে। বর্তমানে বাউলদের বিভিন্নভাবে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে, তাঁদের কর্মের উপর ভিত্তি করে। তবে মনে রাখতে হবে সব কিছুর মধ্যে যেমন খারাপ থাকে ঠিক তেমনি এই গোষ্ঠীর মধ্যেও কিছু রয়েছে। তাঁরা মূলত বাউলদের কলুষিত করতেই এই প্রয়াস বলে আমার কাছে মনে হয়।
বাংলার প্রাণ বাউলের গান আর সমাজের ঘ্রান। সব মিলিয়ে সবুজ বাংলাকে করেছে চিরন্তন সবুজ। বাউল সাধকরা সদা সমাজকে আলোকিত করতে সদয়। শুধু বাউলরা নই সব শ্রেণীর ভালো মানুষ সমাজকে আলোকিত করতে চাই এবং করে যাচ্ছে। আসুন আমরা সবাই সেই আলোকিত পথে হাঁটা শুরু করি ভেদাভেদ ভুলে। আর একটাই শপথ হোক আমাদের সবারঃ-
সত্য বল সু পথে চল ওরে আমার মন,
সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দর্শন।