বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

পাঞ্জু শাহ বার্ষিকী অনুষ্ঠান
পাঞ্জু শাহ বার্ষিকী অনুষ্ঠান

যে কোন জীবন-সচেতন কবি সমাজ-মানস ও জাতীয় সংস্কৃতি- ক্ষেত্রে এমন এক অবদান রেখে যান, যা উত্তরকালের দেশ ও দশের কল্যাণকর জ্ঞানালোকের সন্ধান দেন। সে কারণে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তাঁর কাব্য-চিন্তার বিচার-বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরী হয়ে ওঠে। কেননা সাহিত্য আজকের জন্য যতটা উপযোগী, আগামী দিনের জন্য তার উপযোগীতা তার চেয়ে আরো বেশি। আর সে সাহিত্য যদি মানব-মনের পরমতত্ত্ব-জিজ্ঞাসার ভিত্তিতে রচিত হয় এবং তা যদি মানবিক আবেদনে ভরপুর থাকে, তাহলে কাল থেকে কালান্তরে তার দূর্বার গতি কেউ রোধ করতে পারে না। কবি পাঞ্জু শাহের কাব্য-অবদান সম্পর্কেও একথাটি বিশেষভাবে স্মরণীয়।

পাঞ্জুর জীবন-কাহিনী, আধ্যাত্ব চিন্তার বিকাশ এবং কবি শক্তির উন্মেষ সংক্রান্ত আলোচনা এ প্রসঙ্গে বিশ্লেষিত হয়েছে। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের প্রথম দশকের মননশীল কাব্য-ভাবনার সময়কালে বাস করেও কেন তিনি তত্ত্বকাব্য ও আধ্যাত্ব সংগীত রচনার মধ্যে নিমগ্ন থাকেন, তাও আমরা ব্যাখ্যা করেছি। এখানে শুধু এটুকু বলার আছে যে, পুরাতন মানসিকতা বা অতীত কাব্য-চিন্তা বিনা প্রয়োজনে বা শুধু কল্পনাবিলাসে তিনি লালন করেছিলেন তা নয়। এর পশ্চাতে সঙ্গত কারণ বিদ্যমান।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম দশকে বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে একটি চেতনা দেখা দেয়। আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে তাঁরা এগিয়ে আসেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্য-ক্ষেত্রেও এ সময়েই তাঁদের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। এর পূর্বে এ দিকে মনোনিবেশ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এ সময়টা আবার আধুনিক বাংলা সাহিত্যেরও স্বর্ণ-যুগ। তথাপি যে সব বাঙালী মুসলমান আধুনিক বাংলা সাহিত্য সৃষ্টিতে এ সময় আত্ন নিয়োগ করেন, অগ্রগামী হিন্দু লেখকদের অনুসরণ ব্যতীত তাঁরা নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সাহসী হননি। যে জন্যই শ্রেষ্ঠ হিন্দু লেখকদের তুলনায় তাঁদের সাহিত্যকর্ম নিস্প্রভ। পাঞ্জু শাহ এই দীপ্তিহীন অনুকরণ-সর্বস্ব সাহিত্যকর্মে আত্ননিয়োগ না করে বাংলার সনাতন সাহিত্যধারা অনুসরণই শ্রেয় বলে মনে করেছেন। জাতীয় জীবনের সেই অনিশ্চিত ক্রান্তিলগ্নে আধ্যাত্ববাদের শান্তি-বাণী প্রচারই তাঁর কাছে সর্বোত্তম কর্তব্য বলে মনে হয়েছে। ব্যর্থ অনুকরণ প্রয়াস-লদ্ধ কবি-কর্মের পরিবর্তে মরমীবাদ-ভিত্তিক তত্ত্বকথা শুনিয়ে বরং তিনি আমাদের প্রাণের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। পূর্বোক্ত বক্তব্যমালা থেকে বোধ হয় আমরা কতকটা উপলদ্ধি করতেও পেরেছি।

প্রতিভা-বিচারে দু-শ্রেণীর মানুষের সাক্ষাত মেলে, যথা-‘যুগস্রষ্টা কবি’ ও যুগের দ্বারা সৃষ্ট কবি। পাঞ্জু শাহ শেষোক্ত গোষ্ঠীভূক্ত। মরমী কবি লালন শাহ যে ধারার স্রষ্টা, পাঞ্জু শাহ সে ধারারই প্রবাহ-সৃষ্ট কবি’। লালন শাহের সঙ্গীত শিষ্যই শুধু নন, বরং সমগ্র লালন-মানস ও লালন যুগের অবশিষ্ট দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। লালনের ঈঙ্গিতে ও প্রেরণায় ভাব সঙ্গীত রচনার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কিভাবে পাঞ্জু-প্রতিভার বিকাশ ঘটে, পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা তা দেখিয়েছি। তবে শুধু সঙ্গীত রচনার মধ্যেই সে প্রতিভা সীমাবদ্ধ থাকেনি। দীক্ষাগুরু হিয়াজতুল্লাহ খোন্দকারের নির্দেশে কাব্য-রচনায়ও তা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আগেই বলেছি, এধারা আধুনিক অনুকরণের ধারা নয়। এ কাব্য-ধারা এত সজীব ও আকর্ষণীয় যে, তাঁর পুত্রগণ এবং শিষ্যরা এর অনুকরণে তৎপর হয়েছেন। শুধু তাই নয়, এ ধারা-প্রবাহ বর্তমানকাল পর্যন্ত সচল রয়েছে, একথাও সত্য।

সাহিত্য-কর্মের গুনগত মান বিচারের ক্ষেত্রে পাঞ্জু-রচনাবলী সমকালীন সাহিত্য সম্ভারের পাশাপাশি স্থাপনযোগ্য কিনা, এ প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, সাহিত্যের বিচার কেবলমাত্র সমাজের একশ্রেণীর লোকের মতামতের উপর নির্ভর করে না। সাহিত্য সমগ্র জাতির জন্য রচিত ও প্রচারিত। গণ-মানুষের প্রাণে আবেদন সৃৃষ্টিকারী সাহিত্যকর্ম পরিশীলিত কিংবা অপরিশীলিত এ বিচারের অপেক্ষা রাখে না। তাই বলতে হয় যে, উনিশ শতকের বিদেশী সমালোচনা প্রভাবিত মানদন্ডে পাঞ্জুসাহিত্যের বিচার না করে এর জনপ্রিয়তা ও গণমুখী আবেদনের বিষয়টিই বিবেচ্য। কেননা পুথি আকারে হলেও পাঞ্জু শাহের কাব্য সমগ্র বাংলা ভাষাভাষীর হৃদয় স্পর্শ করেছিল। কবির ‘ছহি ইস্কি ছাদেকী গওহোর’ কাব্যের দুটি সংস্করণ হয় তাঁর জীবদ্দশায়। কবি-পুত্র রইচউদ্দীনের বিবৃতি অনুসারে অদ্যাবধি লক্ষাধিক সংখ্যক পুস্তকও বিক্রীত হয়েছে বলে জানা যায়। কাব্যের জনপ্রিয়তা ও পাঠক সমাজের সমাদর প্রমাণের এটাই যথেষ্ট সাক্ষ্য।

সঙ্গীত আকারে তাঁর সব বাণী ছন্দায়িত হয়েছে, যেগুলোর জনপ্রিয়তাও নিতান্ত কম নয়। সমগ্র বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে তাঁর গানের অসংখ্য ভক্ত, শিল্পী এবং সমঝদার বর্তমান। তাঁর মাযারে অনুষ্ঠিত বাষিক অনুষ্ঠানে অগনিত লোকসমাগম দেখেও একথা বুঝতে পারা যায়। শিষ্য-প্রশিষ্যগণের সাক্ষাৎকার থেকেও এর প্রমাণ মেলে।

পাঞ্জু শাহের সঙ্গীতের ছন্দ, কথা ও রচনা-রীতি হুবহু অনুকরণ করার প্রবণতা শুধু তাঁর শিষ্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এমন না। সমকালীন অন্যান্য ভাব-সাধকগণও এতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। পাঞ্জু-অনুকরণকারী মরমী কবিদের মধ্যে নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলাধীন বজরাহার নিবাসী মরমী কবি আহসান আলী তার উজ্বল দৃষ্টান্ত।

পাঞ্জু শাহের সাহিত্য-অবদান সম্পর্কে আরো একটি কথা উল্লেখযোগ্য। উনিশ শতকের আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও আগমনে ভারত-চন্দ্র রচিত কাব্য-কলা ও কাব্য-শিল্প বিলুপ্ত হয়। কবিরা আর সে ধারা অনুসরণে সক্ষম হন না। কিন্তুু আসলে সে ধারা বিলুপ্ত হয়নি। উনিশ ও বিশ শতকের প্রথম দিকে অসংখ্য মিশ্র- ভাষারীতির কবি তাঁদের কাব্যে এধারা সংরক্ষণের প্রয়াস পেয়েছেন। ঐ যুগের মুসলিম কবিদের ‘ সাহিত্য-সৃষ্টির ক্ষমতা’ এই আরবী-ফারসী শব্দবহুল রচনার মধ্যে বিধৃত হয়ে আছে। যদিও বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনার ইতিহাসে এই কাব্যধারা মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের মধ্যে ঐতিহাসিক সূত্র রক্ষার উপায় মাত্র, তথাপি এটাই মুসলমানদের জাতীয় সাহিত্য। পাঞ্জু শাহ এই জাতীয় সাহিত্যের রুপকার। উনিশ শতকের শহুরে আধুনিক সাহিত্যের তলে তলে গ্রামীণ জীবন ও সমাজের পটভূমিতে রচিত ‘মরমী কাব্য ও মরমী সঙ্গীত’ ভিত্তিক এ ধারাটি ছিল অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো প্রবাহমান।এ যুগের অসংখ্য কাব্যের মধ্যে জামালউদ্দীনের ‘প্রেমরতœ’ বুদ্দু শাহের ‘দিদারে এলাহী’ ইত্যাদি এধারায় পড়ে। পাঞ্জু শাহের ‘ছহি ইস্কে ছাদেকী গওহোর’ ঐ সব কাব্যের সমগোত্রীয়। এদিক থেকে বিচার করলে পাঞ্জু শাহের সাহিত্য অবদানকে নিরর্থক বা মূল্যহীন বলা যায় না। পূর্বোক্ত অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা আছে। সুতরাং এখানে অধিক বক্তব্য অনাবশ্যক।

আমরা জানি, উনিশ শতকের আধুনিক সাহিত্যে ব্যবহৃত ভাষাকে ‘সাধুভাষা’ (সংস্কৃতজাত) এবং আউল-বাউল-ভক্ত কবিদের ভাষাকে ‘অসাধু ভাষা’ বলা হয়েছে। তথাপি এ অসাধু ভাষাই যে বাংলার খাঁটি ভাষা তা রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতে ইংরেজী ভাষায় অভিজ্ঞ পন্ডিতদের হাতেকলমে তৈরী বাংলা হচ্ছে আধুনিক সাহিত্য, এটা বন্ধ্যা নিষ্ফলা সুয়োরাণী। যতেœ ও সম্মানে রক্ষিত মহিষী হয়েও এ সুয়োরাণীর গর্ভে একটি কণ্যা সন্তান জন্মেনি। অর্থ্যৎ এ ভাষায় কোন সজীব ভাব প্রকাশ করা যায়নি। কিছু সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হলেও সংবাদপত্র শয্যাতেই সেগুলোর অপমৃত্যু ঘটেছে। অন্য দিকে দেশীয় ভক্ত কবিদের রচনা, রবীন্দ্রনাথ যাকে দুয়োরাণী বলেছেন, সেই দেশীয় মহিলার গর্ভে দেশের সাহিত্য, দেশের ভাবী আশা ভরসা, হতভাগ্য দেশের একমাত্র স্থায়ী গৌরব জন্মগ্রহণ করেছে। দুয়োরাণীর এই বসনভূষণহীন সর্বাঙ্গে ধুলোমাটিমাখা শিশুটি হচ্ছে প্রাকৃত-দেশজ ভাব ও ভাষায় রচিত বাংলা সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ তাই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের অনুরাগী বন্ধুদের আহবান করে একদা বলেছিলেন-‘আমরা যদি এই অভূষিত ধুলিমলিন শিশুটিকে বক্ষে তুলিয়া লইয়া অহংকার করি, ভরসা করি কেহ কিছু মনে করিবেন না। যাহারা রাজসভায় বসিতেছেন তাহারা ধন্য, যাহারা প্রজাসভায় বসিতেছেন তাদের জয়-জয়কার, আমরা এই উপেক্ষিত অধীন দেশের প্রচলিত ভাষার অন্তরের সুখ-দুঃখ বেদনা প্রকাশ করি, ঘরের কড়ি খরচ করিয়া ছাপাই এবং কড়ি খরচ করিয়া কেহ তাহা কিনিতে চাহেন না - আমাদিগকে অনুগ্রহ করিয়া কেবল একটুখানি অহংকার করিতে দিবেন। সেও বর্তমানের অহংকার নহে, ভবিষ্যতের অহংকার- আমাদের নিজের অহংকার নহে, ভাবী দেশের, সম্ভবত ভাবী ভারতবর্ষের অহংকার। পাঞ্জু শাহ রবীন্দ্রনাথের সেই গর্বের ভাষা - দেশজ ভাষার কবি। ভাষা-রীতি ও অন্যান্য আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা একথাটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

পাঞ্জু শাহের কবি-কর্মের অন্যতম দিক ‘মরমী সঙ্গীত’ রচনা। এ প্রসঙ্গেও লৌকিক সুরের মাধূর্যের কথা বলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য এ বিষয়ে চমৎকার। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘চারদিক দেখিয়া শুনিয়া আমাদের মনে হয়, বাঙালী জাতির যথার্থ ভাষাটি যে কি, তাহা আমরা সকলে ঠিক করিতে পারি নাই, বাঙালী জাতির প্রাণের মধ্যে ভাবগুলি কিরুপ আকারে অবস্থান করে তাহা আমরা জানি না। এই নিমিত্ত আধুনিক বাংলা ভাষায় সচরাচর যাহা কিছু লিখিত হইয়া থাকে তাহার মধ্যে যেন একটি খাঁটি বিশেষত্ব দেখিতে পাই না। পড়িয়া মনে হয় না, বাঙালীতেই ইহা লিখিয়াছে, বাঙালাতেই লেখা সম্ভব এবং ইহা অন্য জাতির ভাষায় অনুবাদ করিলে তাহার বাঙালীর হৃদয়জাত একটি নতুন জিনিস লাভ করিতে পারিবে। ভাল হউক, মন্দ হউক, আজকাল যে সকল লেখা বাহির হইয়া থাকে, তাহা পড়িয়া মনে হয়, এমন লেখা ইংরেজীতে বা অন্যান্য ভাষায় সচরাচর লিখিত হইয়া থাকে বা হইতে পারে। ইহার প্রধান কারণ এখনো আমরা ঠিক ভাবটি, ঠিক ভাষাটি ধরিতে পারি নাই। সংস্কৃতবাগীশেরা বলিবেন - ঠিক কথা বলিয়াছো, আজকালকার লেখায় সমাস দেখিতে পাই না, বিশুদ্ধ সংস্কৃত কথার আদর নাই আর ইংরেজী ব্যাকরণেও বাংলা নাই, বাঙলা ভাষা বাঙালীর হৃদয়ের মধ্যে আছে। পাঞ্জু শাহের ভাষা এই হৃদয়ের ভাষা। রবীন্দ্রনাথের কথার রেশ ধরে এ সিদ্ধান্তে আসা বোধ হয় অসমীচীন নয়।

রবীন্দ্রচিন্তার বিশ্বমূখী অভিযানে বাংলার এই মরমী ভাবসাধনার অভিব্যক্তি নিভৃতে নাবিকের কাজ করেছে। ‘দেশীয় ভাব-ভাষায় মন্ডিত প্রাকৃতজন সাহিত্য’ আপন কোলের ছেলের মতো। তাকে বাইরে খোঁজ করা বৃথা। নিজেকে জেনে স্বদেশের জনচিত্তের অন্তঃস্থলে ডুবে সংস্কৃতির মনি-মানিক্য কুড়িয়ে নিজস্ব প্রতিভার স্পর্শে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে তিনিই তা দান করে গেছেন।’ পাঞ্জু শাহ রবীন্দ্র আহরিত সেই মনি - মানিক্যমালার অন্যতম রত্ন। রবীন্দ্রনাথ লালনকে জেনেছিলেন। লালন-পরিচিতির সাথে অন্যান্য লালন অনুসারীরাও রবীন্দ্রমানসে অপরিচিত ছিলেন না। তবে অনেকেই হয়তো রবীন্দ্রসকাশে প্রত্যক্ষভাবে অবতীর্ণ হবার সুযোগ পাননি। কবি পাঞ্জু শাহ ‘লালন-কমগুল-জল সিঞ্জিত সেই অজ্ঞাতে ফুটে থাকা বাংলার অযত্নে লালিত উদ্যানের মূল্যবান সাহিত্য-কুসুম’ - এ মন্তব্য বোধ করি যথার্থ।

সাহিত্য - সঙ্গীত ক্ষেত্রে পাঞ্জু অবদান সমীক্ষার পর ধর্মীয় চিন্তাজগতে তাঁর মানস - বৈশিষ্ট্যের মূল্যায়ন আবশ্যক। পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে জানা গেছে যে, পাঞ্জু শাহ সুফীবাদ অনুসারী সাধক ছিলেন। চিশতী-নিযামী ঘরনার নিয়ম-কানুন অনুসারে তিনি তাঁর মতাদর্শ প্রচার করেন। একটি নির্দিষ্ট সাধনপন্থী হয়েও কখনো তিনি ধর্মীয় একদেশদর্শীতা, গোঁড়ামি ও অন্ধবিশ্বাসকে প্রশ্রয় দেননি। ধর্মের প্রকৃত তাৎপর্য সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। তবে ইসলামী ভাবধারা ও ধর্মসাধনার চার স্তরের (শরিয়ত,তরিকত,হকিকত,মারেফাত) মাহাত্ন্যকে স্বীকার করেও তিনি মারেফাতের উপরই তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। ধর্মের গুপ্তরহস্য বা তাসাউক যা থেকে সূফীতত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশ, তাকেই তিনি মনুষ্য জন্মের সারৎসার সাধন-পন্থা বলে মেনে নিয়েছেন। সাথে সাথে ধর্মের মূল লক্ষ্য যে মানবতাবোধ, তাও তিনি জীবনে প্রতিফলনে সচেষ্ট হয়েছেন। ধর্মের মূল প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) থেকে তাঁর খলিফা ও অনুসারী সবাইকে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে পাঞ্জু - কাব্য ও সঙ্গীত উৎসারিত। ইসলামের তাপসমন্ডলীর প্রতি ভক্তি রেখে অন্যান্য মহাপুরুষকেও তিনি মানবতাবাদের প্রতীক হিসেবে ভক্তি জানিয়েছেন। সব ধর্মের মূলে একই সত্য - একথা ভেবেই তিনি এ সব মহাপুরুষগণের আর্শিবাদ পর্যন্ত কামনা করেছেন। রাম, কৃষ্ণ, চৈতন্য ইত্যাদি সেই সবই দয়াময়ের প্রতীক। মাহাত্নাদের মধ্যে কবীর, দাদু, রজ্জবজী ইত্যাদি তাঁর বিশেষ শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। মোট কথা, পাঞ্জু শাহ ‘মানব-ধর্ম’ পালনের একান্ত পক্ষপাতী ছিলেন। এখানেই তাঁর ধর্মীয় চিন্তার বৈশিষ্ট্য।

পাঞ্জু - মানসে প্রতিফলিত দর্শন নিয়ে যথাস্থানে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে সে সম্পর্কে আর একটু বলতে গেলে বলা যায় যে, চর্যাপদে বিধৃত ‘যোগ ও তত্ত্ব দর্শন’ অন্যান্য মুসলিম কবিদের মতোই পাঞ্জ শাহ অনুসরণ করেছেন। কায়া-সাধনায় যে হেয়ালী ভরা বক্তব্য চর্যাপদে বিধৃত পাঞ্জু রচনায় তার পূর্ণ আভাস রয়েছে। এ দেশীয় যোগ তান্ত্রিক প্রভাব দ্রাবিড়, আর্য এবং পরবর্তীকালে মুসলিম বহিরাগত অন্যান্য জাতি কেউই অস্বীকার করতে পারেননি। এটা ঐতিহাসিক সত্য। বাংলাদেশী যোগসংক্রান্ত গ্রন্থের আরবী অনুবাদ মুসলিম সাধকগণ পরম যত্নে অধ্যয়ন করে যোগ ও তন্ত্র সাধনা গ্রহণ করেছেন, এ কথাও যথার্থ। সুতরাং মুসলমান সুফী সাধক হয়েও পাঞ্জু শাহ যে কাব্য সাধনা গ্রহণ করেছেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কেননা দেহ থেকে দেহাতীত সাধনায় উত্তরণ সূফীবাদেরও কাম্য। তন্ত্র বিশেষজ্ঞদের মতও উদার। তাঁরা বলেন, হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন, পার্শী - সকল দেশের সকল ধর্মাবলম্বীয় তান্ত্রিক সাধক হইতে পারেন। সমাজে ও সভায় মুসলমান মুসলমানই থাকিবে, খ্রীষ্টান খ্রীষ্টানই থাকিবে, নিজ নিজ ধর্মের কোন ব্যত্যয় ঘটাইবে না ; অথচ সে অধিকারী হইলে সদগুরু পাইলে সাধনায় দীক্ষিত হইতে পারিবে। পাঞ্জু শাহের রচনায় যে তন্ত্র - প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, তা বোধ করি উপযুক্ত সদগুরুর তত্ত্বাবধানে গৃহীত ‘দেহ-সাধনা-পন্থা’ ব্যতীত অন্য কিছু নয়। মৈথুনতত্ত্ব বিষয়ক যেসব বক্তব্য পাঞ্জু রচনায় উদ্ধৃত হয়েছে,তাতেও তাকে কোন বিকৃত যৌনতত্ত্ববিদ মনে করার কোন কারণ নেই। ভারতীয় দর্শনের প্রাচীন ইতিহাসে এবং সেমেটিক দর্শনে (আরবী ধর্মশাস্ত্রে) মানব-মানবী অথবা আদম-হাওয়া কাহিনীর মধ্যেও এ মৈথুনতত্ত্ব নিহিত। ভূমিকাংশে এবিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বস্তুত পাঞ্জ– রচনায় এ তত্ত্ব অতি পরিচ্ছন্ন একটি সাধন-প্রণালী হিসেবে ব্যাখ্যাত হতে দেখি। তা ছাড়া এ মৈথুনতত্ত্ব বাংলাদেশের মরমী দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ও বটে।

গবেষণায় দেখা যায় একটি মাত্র তত্ত্ব-নির্ভর-সাধন পন্থাকে ভিত্তি করে এদেশীয় ফকিরী মতবাদকে ‘বাউল ধর্ম’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। পাঞ্জু শাহ এই তথাকথিত বাউল ধর্মের অন্যতম ধারক-বাহক বলেও গন্য। তবে একথাও ঠিক যে, একটি মাত্র তত্ত্ব (যেমন মৈথুনতত্ত্ব) নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মমত গঠিত হতে পারেনা। একটি ধর্মমত প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে ধর্মের প্রবর্তক, ধর্মের কেতাব এবং বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের সম্বন্বয় প্রয়োজন। বাউল-তত্ত্ব তেমনি একটি ধর্ম নয়, বড় জোর একটি ‘মতবাদ’। তাছাড়া মৈথুনতত্ত্ব মূলত সার্বজনীন ও বিশ্বজনীন জৈবিকতত্ত্ব। শুধু মানুষ নয়, সমগ্র জীবজগত এ তত্ত্বের অধীন। সুতরাং জ্ঞানবান জীব হিসেবে মানুষ যদি এ মৈথুনতত্ত্বকে একটি পরিচ্ছন্ন ও পারলৌকিক জীবনের পাথেও হিসাবে স য়ের মাধ্যম ও সংযম সাধনা ও আত্ননিয়ন্ত্রণের উপায় হিসেবে ব্যবহারিক প্রয়োজনে লাগাতে পারে, তবে তা মানব সমাজের কল্যাণ ছাড়া অকল্যাণ নয়। পাঞ্জু দর্শনের এ কল্যাণকর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। তাঁর রচনাবলী ও মতাদর্শ এদিকেই অঙ্গুলী নির্দেশ করে।

বৈষ্ণব-সাহিত্যে শুধু নয়, সুফীতত্ত্বেও ‘প্রেম’ আশক-মাশুকতত্ত্ব নামে স্বীকৃতি পেয়েছে। বস্তুত এখানেই প্রেম-ক্ষুধিত আত্মার শান্তি নিহিত। তাই দেখা যায়, সুফী - ফার্সি সাহিত্যে লাইলী- মজনু, শিরি-ফরহাদ ইত্যাদি ‘প্রেম ব্যক্তিত্ব’ বাংলায় এসে ‘রাধা-কৃষ্ণ’ রুপকে গৃহীত হয়েছে। মূলত এ তত্ত্ব জীবআত্না ও পরমআত্না প্রেমমূলক সম্বন্ধ ব্যক্ত করে। জনৈক সমালোচকের ভাষায়- ‘বাঙ্গালার সূফীভাবাপন্ন কবিরা জীবআত্না ও পরমআত্না কথা বলিতে যাইয়া লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ প্রভূতি রুপক ব্যবহার না করিয়া বাঙ্গালার জাতীয় রুপক রাধাকৃষ্ণ প্রসঙ্গই গ্রহণ করিয়াছে। বাংলার মরমী মনের মূল সুরটি মনে হয় এখানেই। সূফী-বৈষ্ণব উভয় তত্ত্বই একাত্ম হয়ে সেখানে মিশেছে। এতে জীবআত্না - পরমআত্না মিলনের শেষ পর্যায়ে যে মানবতার আর্তি আছে, পাঞ্জু শাহের ভাষায় তার নিদর্শন রয়েছে প্রচুর। এবিষয়ে আর কিছু না বললেও চলে।

মরমীরা যে ভাব সঙ্গীতের সুরে বাংলায় নিজস্ব সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছেন, লালন শাহ তারই উদ্ভাবক। লালন-দর্শন মূলত ‘মানুষ-রতন-তত্ত্ব’ এবং পাঞ্জু শাহ এ তত্ত্বের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। পূর্বের আলোচনাসমূহে একথাই ব্যক্ত হয়েছে। তবে পাঞ্জুর ‘মানুষ রতন’ বা ‘অধর মানুষ’ একদিকে যেমন আধ্যাতœ মানবতাবাদ নির্দেশক, অন্যদিকে তেমনি আবার নিরপেক্ষ সাধারণ মানবতাবাদেরও পরিপোষক। তাঁর দর্শনেরও এটিই বৈশিষ্ট্য। আরও দেখতে পায় পাঞ্জু শাহের এ ‘মানুষ-রতন-তত্ত্ব’ আসলে সূফীবাদ ভিত্তিক। সূফীরা বলেন - ‘কুলূবেল মুমেনীরা আরশ উল্লাহ অর্থ্যাৎ মুমিনের হৃদয়ে আল্লাহর আরশ বর্তমান।’ কাজেই পাঞ্জু দর্শন কোন অভিনব তত্ত্বভাবনা নয়। মুসলিম দর্শনের অতি জনপ্রিয় মতবাদ - সূফীবাদই তাঁর দর্শনের মূল। তবে এর উপর বাংলাদেশী বিভিন্ন মতবাদেরও প্রভাব পড়েছে। বস্তুত যুক্তিতর্কের পরিবর্তে ভক্তি এবং বিশ্বাস দ্বারা মানসের সাহায্যে মনের মানুষকে উপলদ্ধি করার সাধনাই হচ্ছে পাঞ্জুর তত্ত্ব চিন্তার বুনিয়াদ। এদিক থেকে বিচার করলে পাঞ্জু কে প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদদেরও অন্যতম বলে গণ্য করা যায়। তাঁর তত্ত্বদর্শন আরো স্বার্থকতা লাভ করেছে বংশ পরস্পরায় এর অনুশীলনীর দ্বারা। শিষ্য-প্রশিষ্যদের মাধ্যমেও তাঁর দরবেশী ভাবধারা ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। আর তাই উপমহাদেশের অন্যতম তাত্ত্বিক হিসেবে পাঞ্জু শাহের একটি স্থায়ী আসন বোধ করি অকল্পনীয় নয়।

পাঞ্জু-মানসে যুগ ও পরিবেশ কি প্রভাব বিস্তার করেছিল, সে প্রসঙ্গে একটু আলোচনা আবশ্যক। পাঞ্জু শাহের সমকালে ধর্মে-সাহিত্যে-সমাজে প্রাচীনের প্রতি সন্দেহ এবং অন্ধবিশ্বাসের উপরে ব্যক্তিগত বিবেক ও যুক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সমাজের সব লোক একইভাবে ইংরেজ-প্রভাবে প্রভাবিত হয়নি। ইংরেজের চরিত্র, ইংরেজের শাসন-নীতি ও তদসংক্রান্ত বিবিধ ব্যবস্থা মনীষী ও চিন্তাশীল, ভাবুক ও হৃদয়বান ব্যক্তিদের মনে অবশ্যই চা ল্য সৃষ্টি করে। একই সমস্যা বিভিন্ন রুপ ধরে ভাবে-চিন্তায়-কর্মে প্রকাশিত হয়। ফলে কেউ সমাজ থেকে, কেউবা সমাজ ত্যাগ করে বৈরাগ্যভাবে মজে ব্যাকুলতা ও অধীরতা উপশমের চেষ্টা করেন। দুটি বিপরীত সংস্কৃতির মর্মগত বিরোধ শিক্ষিত অভিজাত বাঙালী সমাজে একটি উৎকন্ঠা জাগিয়ে তোলে। প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি আর নব্য ইউরোপীয় সংস্কৃতি বাঙালী মনে চিন্তার জটিলতা সৃষ্টি করে। পাঞ্জু শাহের মরমীবাদ মানস-জগতে এ জটিলতা একেবারে ছিল না, তা নয়। ইংরেজ পন্ডিত ও শিক্ষাগুরুর মাধ্যমে নব্য বাঙালীর চিত্তে গ্রীক-রোমান-খ্রীস্টান সংস্কৃতি সংক্রামিত হতে থাকে। বাঙালী কবি মধুসূদনের মতো ব্যক্তিত্বও সে প্রভাবমুক্ত হতে পারেননি। কিন্তু জটিলতা সত্ত্বেও পাঞ্জু শাহ বিদেশী ঐ ভাব-বন্যায় ভেসে যেতে চাননি। তাঁর রচনায় পাদরীদের ধর্মপ্রচারের বাড়াবাড়ির কথা উল্লেখ দেখে এটা বোঝা যায়। ধর্মান্তর গ্রহণেও যে মানসিক শান্তি আসে না, একথার ঈঙ্গিত তাঁর রচনায় আছে। তাই বোধ হয়, তিনি সবধর্মের গভীরে নিহিত মর্মমুখ সাধনাকে সর্বমানবের আত্নার শান্তির একমাত্র সহজ পথ হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন।

পাঞ্জু-মানসের চা ল্য সম্পর্কে বাস্তব কথা এই যে, তিনি আভিজাত্য, ধনসম্পদ এবং গোড়ামী বিসর্জনের প্রয়াসে কঠোর সাধনায় আতœনিয়োগ করেন। অন্যদিকে অতি সহজে জীবন ও জগত এবং আদর্শগত ও আধুনিকতা গ্রহণ করেন মনে প্রাণে। তাঁর আধুনিকতা বোধ তাঁকে বাংলা ভাষা শিক্ষায় উদ্বুদ্ভ করে, মনাবতাবোধ তাঁকে মানুষ-গুরু অনুসরণে প্রেরণা জোগায় এবং মরমী ভাবাবেগ তাঁকে ত্যাগের মহিমা শিক্ষা দেয়। একদিকে পারিবারিক প্রথা, অন্যদিকে প্রাচীন-পন্থী পিতার প্রতি শ্রদ্ধা তাঁকে আরবী-ফারসি শিখতে বাধ্য করে। মাতৃভাষার তৃষ্ণা মিটাতে তিনি গোপনে গৃহ-শিক্ষকের সরণাপন্ন হন। তবে এ সবকে অন্তর্দ্বন্দ না বলে প্রাচীন ও আধুনিক উভয় সমাজের প্রতি পাঞ্জু-মানসের শ্রদ্ধাবোধই বলা যায়। এর মধ্যে প্রাচীনের বুনিয়াদে দন্ডায়মান হয়েও তাঁর অন্তরআত্মা আধুনিক জীবন-জগত সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ, প্লাবণ, দূর্ভিক্ষ, সামাজিক বিবাদ-বিসম্বাদ ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁর মনে যে প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, রচনার মধ্যে তার প্রতিফলন তাঁকে নিঃসন্দেহে একজন জীবন-সচেতন আধুনিক কবি হিসেবে প্রতিপন্ন করে। জীবনের শেষ মুহুর্তে পরপার যাত্রার পূর্ব মুহুর্তে বোধ হয় মহাযুদ্ধের খবরদারিও তিনি পেয়েছিলেন। সঙ্গীতে সে খবরও তিনি পরিবেশন করেছিলেন। পাঞ্জু-কবির মানস যে যথেষ্ট প্রগতিশীল চিন্তায় উদ্বুদ্ধ ছিল, এথেকে সে ধারণা করাও অসঙ্গত নয়।

বাইরের সমাজ ও ধর্মীয় পটভূমি বিচারে দেখা য়ায় যে, ওহাবী ও ফারায়েজী আন্দোলন তখন বেশ জোরদার। শিয়া ও সুন্নী উভয় সম্প্রদায়ের মুসলিম মানসের সংঘাত খুব প্রবল। সমাজ-সংস্কারক বেশ কিছু মুসলিম মনীষীর আবির্ভাব এসময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পাঞ্জু শাহের আবাস-অ লে মুনসী মোহাম্মাদ মেহেরউল্লাহ এ সংস্কার আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন। সমগ্র বাংলার মুসলিম চিন্তার পুনর্গঠনে পন্ডিত রিয়াজুদ্দিন মাশহাদী, আব্দুর রহিম, মৌলভী মেয়ারাজুদ্দীন আহমেদ, শেখ জমিরুদ্দীন বিদ্যাবিনোদ ইত্যাদি মহাপ্রাণ ব্যাক্তিদের অবদানও এ প্রসঙ্গে স্মরনীয়। প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামীরুপে চিহ্নিত সিপাহী বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া সমাজ দেহ থেকে তখনও মুছে যায়নি। এই জটপাকানো পরিস্থিতি সম্মুখে নিয়ে পাঞ্জু শাহকে অগ্রসর হতে হয়েছে। সাম্প্রদায়িক বিবাদ, ধর্মীয় বৈষম্যজনিত প্রতিহিংসা ও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির সংগ্রাম তাঁর কাছে একটি কেন্দ্রবিন্দুতে মিলিত হয়ে একটি সমস্যরুপে দেখা দিয়েছে। আর সে সমস্যা হচ্ছে আত্মা জয়ের সমস্যা। তিনি দেখিয়েছেন অশান্তি, বৈষম্য, মতান্তর, আপন আতœার বাইরে নয়। আত্মার কলূষ কালিমা ছাফ করলে জগতে সব সমস্যার সমাধান হয়। সম্বন্বয়বাদী যে চেতনার বীজ তিনি মানুষের মনোভূমিতে রোপন করে দিলেন, তাঁর মহীরুহ - ছায়াতলে আশ্রয় নিল বাংলার অগনিত মানুষ। তাঁর রচনার মধ্যেও এ নীতি ও আদর্শবাদের প্রকাশ দেখি। পূর্ববর্তী আলোচনাতে এ বিষয়টি দৃষ্টান্তসহ উপস্থাপিত হয়েছে। তাই বক্তব্য না বাড়িয়ে আগের মতোই বলতে হয় যে, পাঞ্জু শাহের মতাদর্শ, কোন বিবাদমান বিষয়ে নয়, বরং আত্না-রাজ্য জয়ের নেশায় মানুষকে পাগল করে তুলেছিল। বাংলার প্রায় সর্বত্রই এ আদর্শবাদী ঐশীপ্রেম-পাগলা সম্বন্বয়কারীর অনুসারীর আবির্ভার এর পরোক্ষ ফল। জনৈক সমালোচকের ভাষায়- ‘পান্ডা পুরোহিত মোল্লা-মৌলানা-শাসিত সামন্ত সমাজের আনুষ্ঠানিক ধর্মের আচার বিচার যখন এদেশের কৃষিজীবী খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে বিভেদ ও বিচ্ছেদের বীজ বপন করেছে, জনসাধারণের কবি পাঞ্জু শাহ তখন বিপরীত জীবন দর্শন প্রচার করে ঐক্য ও সম্বন্বয়ের বাণী প্রচার করেছেন। কোন বিধিবদ্ধ শাস্ত্রের গন্ডীতে আবদ্ধ না থেকে বিশ্বমানবতার গান পেয়ে তিনি চোখের জল ফেলেছেন। তাঁর কথার সার কথা হচ্ছে-

‘নানান বরণ গাভীরে তার একই বরণ দুধ।
জগত ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।।’



গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে গ্রামের কবি এ ধরণের এমন এক মহান বাণী পেশ করেছেন যে, বিশ্বপ্রেমের মাহাত্নে, সুগভীর আবেগে, শ্বাশত সত্যের আলোকে তা বিশ্বসাহিত্যের ভান্ডারে অমূল্য রত্ন-মানিক বলে গণ্য। এখানেই পাঞ্জু শাহের সাহিত্য চিন্তা ও তত্ত্ব ভাবনার বিশেষত্ব।

পাঞ্জু শাহ ছিলেন স্বল্প-শিক্ষিত। তবু তাঁর রচনারীতি, ছন্দ ও আঙ্গিক যথেষ্ট উন্নত। এ বিষয়ে যথাস্থানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। পূর্বসুরী সাধক ও কবি অনেকেই তাঁকে কাব্য-প্রেরণা জুগিয়েছেন পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ উভয় প্রকারে। সমকালীন এবং বয়ঃকনিষ্ঠ মরমী কবিদের সঙ্গেও তাঁর সাজুস্য লক্ষণীয়। হাসন রেজা (১৮৫৫-১৯২২) যে দেহত্তবাদী অভিনব সর্বেশ্বরবাদ প্রচার করেন, পাঞ্জু রচনায় তা দূর্লভ নয়। হাসন যেখানে মনে করেন-

‘মন আঁখি হইতে পরদা আসমান জমীন
কর্ণেতে হইল পরদা মুসলমানী দীন।



পাঞ্জু শাহ সে ক্ষেত্রে কলেন-

‘আল্লার যে ভেদ তাই দেহ ছাড়া নাই।
হাদিসেতে আছে তাই আমি বলি নাই।’



এখানে পাঞ্জু শাহ তাঁর সর্বেশ্বরবাদী চিন্তা ব্যক্ত করেছেন। শংকর, স্পিনোজা, শেলিং প্রমূখ দার্শনিকদের তত্ত্ব-ভাবনা তাঁর মধ্যে লোকায়ত বাংলার ভাব সঙ্গীত ও মরমী কবিতায় তা ধরা পড়েছে। এ চিন্তা মূলত এক- স্রষ্টার সর্বব্যাপী বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মানুষকে ভালোবাসার কথাই ব্যক্ত করে।

স্মরণ করা যেতে পারে, উনিশ ও বিশ শতকে সর্বজাতীর মিলন ঘটাতে এদেশের মাটিতে বিভিন্ন নেতার আবির্ভাব ঘটেছে। কিন্তু এসব নেতার মিলন-সাধন-প্রয়াস ব্যর্থ। বাহ্যিক আড়ম্বর লোক দেখানো জাকজমক ব্যতীত এ সব উদ্যোগের আর কোন অর্থ নেই। এক্ষেত্রে উপেক্ষিত, অবহেলিত মরমী সাধকদের নিরাভরণ কর্মপ্রচেষ্টা বরং অনেকখানি স্বার্থক। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেন, - ‘আমাদের দেশে যারা নিজেদের শিক্ষিত বলেন, তারা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমান মিলনের নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অন্য দেশের ঐতিহাসিক স্কুলে তাদের শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশের ইতিহাস আজ পর্যন্ত প্রয়োজনের মধ্যে নয়, পরন্ত মানুষ ও অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন করে এসেছে।’ এ সাধনা ঐ মরমী সাধক সম্প্রদায়ই সম্পন্ন করেছে। বস্তুত সার্বজনীন তাঁদের বাণী ও তত্ত্বচিন্তা। এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই। তারা একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। তাদের এ মিলনে কোন সভা সমিতির প্রয়োজন হয়নি। মরমী সঙ্গীতই আসলে এ মিলন সাধনার মূলমন্ত্র। এ সঙ্গীতের ভাষা অশিক্ষিত মাধূর্যে সরস। অথচ বাংলাদেশের গ্রামের গভীর চিত্তে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা স্কুল-কলেজের অগোচরে কি রকম কাজ করে এসেছে, হিন্দু-মুসলমানের জন্যে এক আসন রচনার চেষ্টা করেছে, এ সঙ্গীত তারই প্রমাণ। পাঞ্জু শাহ এই মরমী গীতির স্বার্থক গীতিকার ও তত্ত্ব-রসিক কবি। এ হিসেবে তিনি জাতি-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের মিলন-সাধক।

পরিশেষে বলা যায়, উনিশ ও বিশ শতকের অস্থির যুগসন্ধিক্ষণে আরবী-ফারসী-ইংরেজী প্রভাবিত মিশ্র সংস্কৃতিতে নিমজ্জমান বাংলার লোকায়ত জীবন-ধারায় পাঞ্জু শাহ যে সম্বন্বিত সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন, তা তাঁর বিশুদ্ধ মরমী চিন্তারই ফল। সূফীতত্ত্বমূলক কাব্য ও ভাব-সঙ্গীত তাঁর এ চিন্তার আধার। বস্তুত পুথির ছন্দ ও ভাব-সঙ্গীতের সুর এই কবির বাণীকে গণ-মানুষের মর্মমূলে পৌঁছে দিয়েছে। সুতরাং বাংলা সাহিত্যের আসনে তিনি যে একটি গৌরবময় আসনের অধিকারী, এতে কোন সন্দেহ নেই। বাংলা ভাষাভাষী জনসাধারণ চিরদিন তাঁর কবি-কর্ম, তত্ত্ব-ভাবনা ও মানসিকতা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। আর স্মরণীয় বরণীয় হবার এক্ষেত্রে মরমী কাব্য-সাধনায় কবি পাঞ্জু শাহের অমর অবদান।

Add comment

সংস্কৃতি এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.