বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

পাঞ্জু শাহ্‌ সৃতি বিজড়িত বটগাছ
পাঞ্জু শাহ্‌ সৃতি বিজড়িত বটগাছ

মরমী সাহিত্য ধারায় লালন শাহ্‌ অত্যন্ত জনপ্রিয়। লালন পরবর্তী মরমী কবিগণের মধ্যে পাঞ্জু শাহের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। লালন শাহের আশিবানী ও স্বীকৃতি পাঞ্জুকে মরমী সাধক সমাজে পরিচিত করে তোলে এবং দীর্ঘদিন এ দেশের সাধক মণ্ডলীর পরিচালক রূপে নিয়োজিত রাখে। এ সম্পর্কে খোন্দকার রফি উদ্দিনের মন্তব্য বিশেষ মূল্যবান। তিনি বলেন- “বাংলার সূফী ফকিরদের মধ্যে লালনের স্থান সর্বচ্চো। কিন্তু লালনের তিরোধানের পর যিনি সারা বাংলার ফকির মহলে লালনের শূন্যস্থান পূরণ করে রেখেছিলেন।” অসাধারণ প্রতিভা-ধর লালন শাহের তিরোভাব-জনিত শূন্যতা পূরণের ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন পাঞ্জু শাহ্‌।

এ কথাটি চিন্তা করলে পাঞ্জু প্রতিভা সম্পর্কে আর দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ থাকে না। বস্তুত পাঞ্জু শাহ্‌ যথার্থ পূর্বসুরির মর্যাদা উপলব্ধি করেছিলেন। সেজন্যে তিনিও লালনের ভাবশিষ্য হয়েই কাব্য চর্চার আত্ননিয়োগ করেন। ফলে সমকালীন বাংলাদেশে পাঞ্জুর কবি-খ্যাতি ও মরমী ভাব সাধনা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। তাই দেখা যায়, “লালন শাহের অত্যন্ত বয়ঃকনিষ্ঠ সমসাময়িক” এই সাধক একটি স্বতন্ত্র ঘরানা ও বিশেষ “কাব্য-সঙ্গীত” গোষ্ঠীর উদ্যেক্তা হিসেবে উনিশ শতকের শেষাধে ও বিশ শতকের প্রথমার্ধে এদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ক্ষেত্রে বিরাজমান। এসব দিক বিবেচনা করলে পাঞ্জুর জীবনেতিহাস বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

কবি পাঞ্জু শাহ্‌ ১২৫৮ বঙ্গাব্দের (১৮৫১ খ্রী) ২৮শে শ্রাবণ ঝিনাইদাহ জেলার শৈলকূপা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ঐ সময় কবির পিতা খাদেমালী খোন্দকার এবং কবি মাতা জোহরা বেগম শৈলকূপাতেই তাঁদের নিজস্ব জমিদার ভবনে বাস করতেন।

খাদেমালী খোন্দকার ছিলেন পাঁচ সন্তানের জনক। এরা যথাক্রমেঃ- শাহারণ নেছা, তহিরণ নেছা, পাঞ্জু খোন্দকার, ওয়াসীমউদ্দিন খোন্দকার ও আইমানী নেছা। পাঞ্জু তদীয় পিতার তৃতীয় সন্তান।

খাদেমালী খোন্দকার যখন শৈলকূপা ত্যাগ করে হরিশপুর অভিমুখে যাত্রা করেন, তখন তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা শ্বশুরালয়ে, মধ্যমা কন্যা পরলোকে এবং কনিষ্ঠা কন্যার জন্মই হয়নি। সুতারাং ভাগ্য-বিড়ম্বনার সেই আমানিশায় বালক পাঞ্জু এবং শিশু ওয়াসীম পিতার সহযাত্রী ছিলেন। হরিশপুর গ্রামে বসতী স্থাপনের পর পাঞ্জু ভগ্নী আয়মানীর জন্ম হয়।

পাঞ্জু শাহের জীবন প্রকৃতপক্ষে হরিশপুর থেকেই শুরু। “বসতি মোকান মেরা হরিশপুর গ্রাম” – একথা বলে কবি এ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেন। বস্তুত বিলাসী জমিদার-নন্দন রূপে নন, কঠোর সংগ্রামী মোল্লার সন্তান রুপেই তিনি বর্ধিত হতে থাকেন। কোন বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেখার সুযোগ তাঁর হয় না। গৃহ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে আরবী-ফারসী শিক্ষার মধ্যদিয়ে তাঁর বাল্যকাল অতিবাহিত হয়।

পাঞ্জু শাহের পিতা ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলমান। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি তাঁর ছিল অসাধারণ শ্রদ্ধাবোধ। খোন্দকার রফিউদ্দিন বলেন – “ফকির পাঞ্জু শাহের পিতা একজন গোড়া মুসলমান ছিলেন। শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি নিষ্ঠাবান হয়ে ইনি বাংলা ভাষা শিক্ষারই বিরোধী হন।” পিতৃপ্রভাতে পাঞ্জু শাহ্‌ বাল্য-কালে আরবী-ফারসী ব্যতীত বাংলা-ইংরেজি শিখতে পারেন না। কিন্তু বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তিনি উপলব্ধি করেন যে, মাতৃভাষা উত্তমরূপে আয়ত্ত করতে না পারলে চিন্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। ফলে “ষোল বছর বয়সে তিনি হরিশপুরে নিবাসী মহর আলী বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে অতি সংগোপনে বাংলা ভাষা শিখেন।”

এখানেই শেষ হয় পাঞ্জু শাহের অনিয়মিত ছাত্রজীবন। সংসারে বেশ খানিক দায়িত্ব তাঁর উপর এসে পড়ে। বৃদ্ধ পিতার সাহায্যকরে তিনি বৈষয়িক কাজে আত্ন-নিয়োগ করতে বাধ্য হন।

চব্বিশ বছর বয়সে চুয়াডাঙ্গা জেলার অন্তর্গত আইলহাস-লক্ষীপুর নিবাসী আব্দুর রহমান খোন্দকারের কন্যা ছন্দন নেছার সাথে তাঁর বিয়ে হয়। পুণ্যবতী গুণবতী এ জীবন-সাঙ্গিনী পাঞ্জুকে নানাভাবে অনেক প্রেরণা জুগিয়েছেন।

বিয়ের দু বছর পর তাঁর প্রথম সন্তান শামসউদ্দিনের জন্ম হয়। এর পর কয়েক বছরের ব্যবধানে কলিমন নেছা ও ছালেহা খাতুন নামে তাঁর দুই কন্যা জন্মে।

সাতাশ বছর বয়সে পাঞ্জু শাহ্‌ তাঁর পিতাকে হারান। তখন থেকে সংসারে ষোল আনা দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত হয়। কর্তব্যপরায়ণ পাঞ্জুও সে দায়িত্ব পালনে কখনো পরাম্মুখ হননি। বস্তুত বৈষায়িক কোন কাজেই তিনি অবহেলা করতেন না। পরিবারের সকলেরই সুখসুবিধা বিধানে তাঁর বিশেষ লক্ষ্য ছিল। এ সময় পৈতৃক বসতবাড়ি কনিষ্ঠ ভ্রাতা ওয়াসিমউদ্দিন খোন্দকারকে ছেড়ে দিয়ে পাঞ্জু শাহ্‌ সাত বিঘা সম্পত্তি খরিদ করে নতুন বসতবাড়ি তৈরি করে নেন। এ ছাড়া পঁচিশ বিঘা মাঠান জমি নিজের নামে ক্রয় করে সংসারে স্বচ্ছলতা বৃদ্ধিরও চেষ্টা করেন।

কৈশোরকাল থেকেই পাঞ্জু শাহ্‌ মরমীবাদের প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। কিন্তু গোঁড়া পিতার ভয়ে তাঁর জীবিতকাল পর্যন্ত প্রকাশ্যভাবে কোন ফকিরী মজলিশে তিনি যোগ দিতেন না। পিতার অন্তর্ধানের পর ফকিরী মাহফিলে স্বাধীনভাবে তাঁর যাতায়াত শুরু হয়ে যায়। এ সময় হিরাজতুল্লাহ খোন্দকার নামে জনৈক তত্ত্ব সাধকের নিকট তিনি দীক্ষা গ্রহণ করেন। পাঞ্জু-মানসে মরমী চেতনার উম্মেষ, তাঁর গুরু পরিচয়, দীক্ষা গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে পৃথকভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে তাই অধিক বক্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

সমাজ জীবনেও পাঞ্জু শাহ্‌ অত্যন্ত অমায়িক ও জনপ্রিয় ছিলেন। সমাজের মান্যমান ব্যক্তিগণকে তিনি খুব শ্রদ্ধা করতেন, তাঁদের নিয়ে দরবারে বসতেন এবং সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে তাঁদের পরামর্শ চাইতেন। অতিথি-পরায়ণতা তাঁর চরিত্রের বিশেষ বৈশিস্ট্য ছিল। কোন প্রাথীকে তিনি শূন্য হাতে ফিরাতেন না। অন্ধ, আতুর, কালা, বোবা ইত্যাদি ভিক্ষুক সর্বক্ষণ তাঁর কাছে থেকে ভিক্ষা পেতো।

পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে পাঞ্জু শাহ্‌ খেরকা (ফকিরী পোশাক) গ্রহণ করেন। তখন থেকে শুরু হয় তাঁর পূর্ণ সাধক-জীবন। একটি অধ্যান্ত চেতনা লাভ করে তিনি সাধনার তুরীয়মারগে উপনীত হন। তত্ত্বজ্ঞান লাভের আশায় অনেক লোক তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। আখড়া তত্ত্বাবধানের জন্য এ সময় তাঁর আরো একজন জীবন-সঙ্গিনীর আবশ্যকতা দেখা দেয়। তখন তিনি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার বড়ুলিয়া নিবাসী আফিলউদ্দিন প্রামাণিকের কন্যা পাচি নেছাকে দ্বিতীয় স্ত্রী রূপে গ্রহণ করেন। উভয় স্ত্রীকেই কবি সমান মর্যাদা দিতেন। তিনি প্রথম স্ত্রী ছন্দন নেছাকে আদর করে “রজনী” এবং দ্বিতীয় স্ত্রীকে পাচি নেছাকে সোহাগ ভরে “প্রেয়সী” বলে ডাকতেন।

পাচি নেছার গর্ভে তিন পুত্র ও এক কন্যার জন্ম হয়। তাঁরা যথাক্রমেঃ খোন্দকার কার শফিউদ্দিন, জয়তুন নেছা, খোন্দকার রফিউদ্দিন এবং খোন্দকার রইছউদ্দিন। ছন্দন নেছার গর্ভজাত খোন্দকার শামসউদ্দিন, কলিমন নেছা, ও ছালেহা খাতুন সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে। পাঞ্জু সন্তানদের মধ্যে কেবল রইছউদ্দিন এখনো জীবিত আছেন। শামস উদ্দিন, শফিউদ্দিন, রফিউদ্দিন ও জয়তুন নেছা ইহলোকে ত্যাগ করেছেন।

ব্যক্তিগত জীবনেও পাঞ্জু শাহ্‌ ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিদা এবং বিলাসবিহীন। সামান্য ডাল-ভাত খেয়েই তিনি জীবনধারণ করতেন। তিনি মাছ খেতেন কিন্তু মাংস খেতেন না। তাঁর অনুকরণে তদীয় শিষ্যদের অনেকে মাংস বর্জন করে চলতেন। তবে এ বিষয়ে তাঁর কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল এমন কথা শোনা যায় না।

তাছাড়া মাংসকে তিনি কোন অখাদ্য বলেও মনে করেননি। তাঁর মাতা নাকি অত্যন্ত মাংসপ্রিয় ছিলেন। মাতার আহারের জন্যে পাড়া প্রতিবেশী বাড়ি থেকে মুরগীর মাংস রান্না করিয়ে এনে তিনি মাতার শিয়রে চব্বিশ ঘণ্টা রাখার ব্যবস্থা করতেন এবং মাতা চাইবামাত্র মাংস খেতে দিতেন।

পাঞ্জু শাহের বাস্তব জীবনের সাথে একটি স্বতঃস্ফূর্ত কাব্য-জীবন সংযুক্ত। আপন হৃদয়ে সঞ্চিত তত্ত্বজ্ঞান বিকশিত হয়েছে তাঁর কবিতা ও গানে। মরমী সাধনা ও স্বভাব কবিত্ব তদীয় কাব্য ও সঙ্গীতে এক অপূর্ব রূপ ধারণ করেছে। কিন্তু এই সাহিত্যকীর্তির মুল্যায়নের তেমন কোন উদ্যেগ গৃহীত হয়নি। ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যেপাধ্যায় যথার্থ বলেছেন – “আমরা লালন ফকিরের কবিত্ব ও অধ্যাত্বতত্ত সম্পর্কে যত কৌতূহলী, পাঞ্জু শাহ্‌ সম্পর্কে তত কৌতূহলী নই। পাঞ্জু শাহ্‌ যে অধ্যাত্ন মার্গের একজন অগ্রচারি সাধক এবং স্বভাব কবি ছিলেন, তা আজ প্রচারের দরকার।” বস্তুত কবির রচনাবলী প্রচারের মাধ্যমেই তাঁর কাব্য সাধনার ধারা উপলদ্ধি করা যায়। পাঞ্জু শাহের ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য।

এই স্বনামধন্য সাধক কবি ১৩২১ বঙ্গাব্দ (১৯১৪ খ্রিঃ) ২৮শে শ্রাবণ ৬৩ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। হরিশপুরে তাঁর আখড়াবাড়ির প্রাঙ্গনে তিনি সমাহিত আছেন। পত্নীদ্বয় তাঁর উভয় পাসে শায়িতা। শিষ্যদের উদ্যেগে মাজারটির উপর পাকা স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে।

উল্লেখ্য, পাঞ্জু শাহ্‌ ও তাঁর স্ত্রীদ্বয় কবর পশ্চিম শিয়রী। কবির অন্তিম অনুরোধেই নাকি ওভাবে তাঁদেরকে সমাধিস্থ করা হয়। ব্যতিক্রমধর্মী এ মাজার দর্শনে দেশ-বিদেশ থেকে বহু লোকের আগমন ঘটে। ভক্তগণ বছরে তিনবার এখানে মরমী সাহিত্য সম্মেলন ও স্মৃতিবার্ষিকী উদযাপন করেন।

Add comment

সংস্কৃতি এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.