বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া মুক্ত দিবস
১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া মুক্ত দিবস

১১ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের এই দিনে কুষ্টিয়া জেলার মুক্তি সেনারা রক্তক্ষয়ই সংগ্রাম করে ছোট-বড় ২২ যুদ্ধ শেষে পাকবাহিনীর হাত থেকে কুষ্টিয়াকে মুক্ত করেছিলেন। অত্যাধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হানাদার পাকসেনার বিরুদ্ধে সাহসী বাঙ্গালী তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা অমিত তেজে অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে কুষ্টিয়ার পবিত্র মাটি পাক হানাদার সেনাদের হটিয়ে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের গগণবিদারী ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে সেদিন কুষ্টিয়ার আকাশ-বাতাস মুখোরিত হয়ে উঠেছিল।

পথে প্রান্তরে গড়ে তোলা হয়েছিল বেরিকেড। লাঠি-সড়কি, ঢাল-তলোয়ার নিয়ে হরিপুর-বারখাদা, জুগিয়া, আলামপুর, দহকোলা, জিয়ারুখী, কয়া, সুলতানপুর, পোড়াদহ, বাড়াদিসহ বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ ছুটে এসেছিল কুষ্টিয়া শহরে

ঐতিহাসিক ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণে সেদিন সে সব মানুষের চোখে মুখে ছিল মুক্তির নেশা, প্রাণে ছিল বঙ্গবন্ধুর শেষ উচ্চারণ-‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। মুক্তির সনদ উচ্চারণকে বুকে ধারণ করে সারা দেশের ন্যায় কুষ্টিয়ার মুক্তিকামী মানুষেরাও প্রস্ত্ততি নেয় মুক্তির পথ অন্নেষণে। এই ভাষনের পর পরই বাঙালীদের প্রতিহত করতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ যুদ্ধ পরিকল্পনা হিসেবে পাক সেনাবাহিনীর ২৭ বেলুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানী সৈন্য ২৫ মার্চ রাতে যশোর সেনানিবাস থেকে কুষ্টিয়া এসে অবস্থান গ্রহণ করে। এবং এক নাগাড়ে ৩০ ঘন্টার জন্য সান্ধ্য আইন জারি করে সশস্ত্র অবস্থায় টহল দিতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর মেজর আবু ওসমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। ঐ সময় ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে লেঃ কঃ রেজাউল করিমের নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়মিত শীতকালীন মহড়ায় যশোর ঝিকর গাছায় অবস্থান করছিল। এ সময় কুষ্টিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্ববৃন্দ এবং আবু ওসমানের সাথে আলাপ আলোচনা স্বাপেক্ষে ক্যাপঃ আযম চৌধুরীকে যশোরে ঝিকর গাছায় প্রেরণ করা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়ার জন্য। কিন্তু তার কোন ফলশ্রুতি না দেখে ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী সেখান থেকে ফেরত এসে মুজাহিদ, আনসার এবং স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রসমাজ, সর্বস্তরের জনতাকে নিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন।

স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কর্মসুচী অনুযায়ী ২৩ মার্চ কুষ্টিয়া ইসলামীয়া কলেজের মাঠে স্বতঃস্ফুর্ত জনতার উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কুষ্টিয়া জেলা শাখার আহবায়ক,আঃ জলিল পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময়, সেখানে উপস্থিত ছিলেন, শেখ দলিল উদ্দিন, মারফত আলী, লোকমান হোসেন, জামাল উদ্দিন খালেদ, সাইফুদ্দিন তারেক (বীরপ্রতীক) পরবর্তিতে যুদ্ধে নিহত হয় এবং সর্বস্তরের জনতা। স্বাধীনতাপ্রিয় কুষ্টিয়ার মানুষ সেনা বাহিনীর এ জাতীয় কার্যক্রম সেদিন মেনে নিতে পারেনি। সান্ধ্য আইন ভেঙ্গে তারা বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। তৈরি করে বেরিকেড। মজমপুর, থানাপাড়া, আমলাপাড়া, বড় বাজার গেটের কাছে জনসাধারণ রাসত্মার উপর ইট-পাটকেল, কাটা গাছের গুড়ি, এমনকি ঘরের চাল নিয়ে এসে সেনাবাহিনীর চলাচল বিঘ্ন করার উদ্দেশ্যে বেরিকেড তৈরি করে। সেনাবাহিনী সেগুলো সরিয়ে ফেলে যেন আরো মারমুখী হয়ে যায়। শুরু হয়ে যায় তুমুল যুদ্ধ।

২৫ মার্চ বেলুচ রেজিমেন্টের ১৪৭ জন সৈন্য রাত ১১ টায় পুলিশ লাইন, জেলা স্কুল, থানা ও আড়ুয়াপাড়াস্থ ওয়ারলেস অফিস ও টেলিগ্রাফ অফিসে অবস্থান গ্রহণ করে। অপরদিকে বেসামরিক মানুষ ও তৎকালীন রাজনৈতিক স্থানীয় নেতারা এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর শেষ নির্দেশ পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহন করেন। চারিদিকে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমান সিভিল সার্জন অফিসের সামনে ২৭ মার্চ একতলা ভবন থেকে রনি রেহমান নামে এক তরুণ ছাত্র পাকসেনাদের গাড়ীর উপর হাতবোমা নিক্ষেপের সময় গুলীতে প্রাণ হারায়। রনি রেহমানই মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়ার প্রথম শহীদ। এ দিনই পাকবাহিনী শহরের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষের উপর নির্বিচারে গুলীবর্ষণ শুরু করে। এতে তাৎক্ষণিকভাবেই ৭ জন মারা যায়। তাদের মধ্যে কোর্ট ষ্টেশনের জ্ঞানা সেন, কোর্টপাড়ার হাসেমের নাম জানা যায়। পাক বাহিনীর অত্যাচার আর গণহত্যায় কুষ্টিয়ার জনগণ বিদ্রোহী হয়ে উঠে। ইপিআর- এর যশোরের সেক্টরের নিয়ন্ত্রণাধীন মেজর এম এ ওসমান চৌধুরী উইং কমান্ডার এবং ক্যাপ্টেন সাদেক সহকারী অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন। ৫ টি কোম্পানী ও ১ টি সাপোর্ট প্লাটুনের সমন্বয়ে ছিল ৪ নং উইং। এই উইং-এর অধীনে প্রাগপুর এলাকা‘ এ’ কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার মোজাফ্ফর আহমেদ, ধোপাখালী, এলাকা বি কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার খায়রুল বাশার খান, বৈদ্যনাথতলা (১৫ এপ্রিলের পর মুজিবনগর) ‘সি’ কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার মুকিদ, যাদবপুর এলাকা‘ ডি’ কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার মজিদ মোল্লা, উইং সদর দপ্তর‘ই’ কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার রাজ্জাক দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়া সিগন্যাল প্লাটুন হাবিলদার মুসলেম উদ্দিনের অধীনে উইং সদর দপ্তরে অবস্থান করছিল। প্রত্যেকটি কোম্পানী প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। একটি কোম্পানীতে ৫ টি হালকা ট্যাংক বিধ্বংসি কামান, ৭ টা হালকা মেশিনগান, ১ টা মেশিনগান এবং বাকী ৩০৩ রাইফেল ছিল। উইং সদর দপ্তরে ১ কোম্পানী সৈন্য ছাড়াও ৬ টি ৩ ইঞ্চি মর্টার ও ২০০ চাইনিজ স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ছিল। এ ছাড়া একটি ব্যাটালিয়ন যুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য গোলাবারুদ ও যানবাহন চার নম্বর উইং-এ ছিল। অপরদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ছিল মেজর শোয়েব। ক্যাপ্টেন শাকিল, ক্যাপ্টেন সামাদ, এ লেঃ আতাউল্লাহ শাহ তার অধীনস্থ অফিসার হিসেবে কুষ্টিয়ায় অবস্থান করেছিল।

পাক বাহিনীর সঙ্গে ছিল ১০৬ এমএম জীপ আরোহিত রিকয়েলস রাইফেল ভারী ও হালকা চাইনিজ মেশিনগান, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, শক্তিশালী বেতারযন্ত্র এবং প্রচুর গোলাবারুদ। মেজর ওসমান চৌধুরী ২৫ মার্চ রাতে সস্ত্রীক কুষ্টিয়া সার্কিট্হাউসে অবস্থান করছিলেন। ২৬ মার্চ সকাল থেকে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা থেকে বেতারে নতুন নতুন সামরিক বিধি জারী করতে থাকলে তিনি দ্রুত ঝিনেদা হয়ে চুয়াডাঙ্গা পৌঁছেই এক জরুরী সভা ডাকেন। ক্যাপ্টেন এ আর আযম চৌধুরী, ডাঃ আসাবুল হক এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও পুলিশ কর্মকর্তাগণ এক গোপন সভায় মিলিত হন। এদিকে ২৭ মার্চ সকালে পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন সাদেক যাদবপুর কোম্পানী সদর দপ্তরে এসে সৈনিকদের নিরস্ত্র হতে বলে এবং সে সময় জনৈক বাঙ্গালী গার্ডের সাথে ক্যাপ্টেন অসাদচরণ করলে সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে ক্যাপ্টেন সাদেকসহ তার পাঞ্জাবী সহযোগিরা নিহত হয়। এই আকষ্মিক সংঘর্ষের পর মেজর ওসমান প্রশাসনিক বিষয়, সামরিক ও বেসামরিক সিন্ধামত্ম এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগ স্থাপন ও রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। সংসদ সদস্য ডাঃ আসাবুল হক, এ্যাডঃ ইউনুস আলী ও ব্যারিষ্টার বাদল রশীদ এই উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন। উপদেষ্টা পরিষদের সাথে আলাপ করেই কুষ্টিয়া জেলা শ্রত্রুমুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। মেজর ওসমান সীমান্তে অবস্থানরত সব ইপিআর সৈনিকদের চুয়াডাঙ্গা সদর দপ্তরে সমবেত এবং প্রাগপুরের কোম্পানী কমান্ডার সমবেত এবং প্রাগপুরের কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার মোজা্ফ্ফরকে কুষ্টিয়ার পথে অভিযান শুরু করার নির্দেশ দেন।

কুষ্টিয়া শহরের পুলিশ লাইন, জিলা স্কুল ও আড়ুয়াপাড়া ওয়ারলেসে পাকবাহিনী অবস্থান নিয়েছিল। তিনদিক থেকে একই সময় যুগোপৎ আক্রমন করার পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরীকে জেলা স্কুলে অবস্থিত সৈন্য ঘাঁটির উপর আক্রমন চালানোর আদেশ দেয়া হয়। এই তিনটি স্থানের মধ্যে জিলা স্কুল ছিল সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী। পাক ঘাঁটি সুবেদার মোজাফ্ফরকে পুলিশ লাইন ও নায়েক সুবেদার মনিরুজ্জামানকে (পরবর্তীতে শহীদ) ওয়ারলেস ষ্টেশন আক্রমন করতে আদেশ দেয়া হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য কোন রকম ফিল্ড ওয়ারলেস বা ফিল্ড টেলিফোনও ছিল না তখন। অগত্যা টেলিফোন বিভাগের সাহায্য পোড়াদহের আইলচারা গ্রামের একটি মাঠে ফিল্ড এক্সচেঞ্জ লাগানো হয়। ডাঃ আসহাবুল হকের নেতৃত্বে ফিল্ড চিকিৎসা কেন্দ্র, ডাক্তার ও ওষধের ব্যবস্থা করা হয়। ২৮ মার্চ দুপুর ১২ টার মধ্যে সীমান্তের সমস্ত কোম্পানী আদেশক্রমে চুয়াডাঙ্গায় সমবেত হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এক কোম্পানী সৈন্য ঝিনেদা পাঠানো হয়। এবং সেখানে তারা যশোর-ঝিনেদা সড়ক অবরোধ করে যেন যশোর সেনানিবাস থেকে কোন সৈন্য বা অস্ত্র কুষ্টিয়াকে সরবরাহ করতে না পারে।

অন্য আর এক কোম্পানী সৈন্য ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরীর নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গা পোড়াদহ কাঁচা রাস্তা দিয়ে পোড়াদহে পাঠানো হয়। ক্যাপ্টেন আযমের প্রতি নির্দেশ ছিল তার গন্তব্যস্থানে পৌছাবার পরেই যেন সে সুবেদার মোজাফফরের সাথে যোগাযোগ করে চুয়াডাঙ্গা হেড কোয়াটারে রিপোর্ট পাঠায়। পরিকল্পনা ছিল ক্যাপ্টেন আযমের কোম্পানী শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অর্থাৎ সার্কিট হাউসে আক্রমন করবে এবং সুবেদার মোজাফফরের কোম্পানী পুলিশ লাইন ও এক প্লাটুন সৈন্য এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কিছু লোক পূর্বদিক থেকে নায়েব সুবেদার মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে মোহিনী মিল সংলগ্ন ওয়ারলেস ষ্টেশনের উপর আক্রমন চালাবে। এবং ঐক্যবদ্ধ আক্রমন হবে একই সময়ে তিনদিক থেকে। আক্রমনের তারিখ নির্ধারণ হয় ২৯ মার্চ ভোর ৪টা। সমসত্ম আয়োজন সম্পন্ন। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধার কারণে এবং ১ টা গাড়ী দুর্ঘটনার কারণে সুবেদার মোজাফফরের সৈন্য নির্দিষ্ট স্থানে পৌছাতে পারেনি। ফলে পরের দিন অর্থাৎ ৩০ মার্চ ভোর ৪ টার সময় নির্ধারিত হয়। ৩০ মার্চ ভোর ৪ টায় তিনদিক থেকে অতর্কিতভাবে কুষ্টিয়ায় আক্রমন শুরু হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমনের সাথে সাথে স্থানীয় হাজার হাজার জনগণ গগণবিদারী‘ জয় বাংলা’ জয়ধ্বনিতে কুষ্টিয়ার আকাশ বাতাস মুখোরিত করে তোলে। এতে শত্রু পক্ষের মনোবল মারাত্মক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে। মাত্র এক ঘন্টা তুমূল যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধা ও সৈন্যরা পুলিশ লাইন ও ওয়ারলেস কেন্দ্রের ভেতর ঢুকে শত্রু খতম করতে থাকে। উপায়ান্তর না দেখে সামান্য সংখ্যক পাকিসত্মানি সৈন্য ভীত হয়ে তাদের অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিয়ে সদর দপ্তর জিলা স্কুলের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। পালাবার সময় অনেক পাক সৈন্য নিহত হয়।

পুরোদিনের যুদ্ধে একমাত্র জিলা স্কুল ছাড়া সমস্ত শহর মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে যায়। বিজয় উল্লাসে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল শক্তিতে জিলা স্কুলের চারদিকে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। এ সময় হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সরবরাহ করতে থাকে। এদিকে ওয়ারলেস সেটে শত্রুপক্ষের আবেদন ধরা পড়ে। যশোর সেনানিবাস থেকে প্রতি উত্তরে জানিয়েছিল, তোমাদের সাহায্য করা সম্ভব নয়। নিজ চেষ্টায় আত্মরক্ষা কর।’ পরদিন ৩১ মার্চ তুমূল যুদ্ধ চলে। সারাদিন যুদ্ধের পর জীবিত শত্রুর সংখ্যা ছিল ৪০/৫০ জন। তার মধ্যে অধিকাংশই অফিসার। গত্যমত্মর না দেখে রাতের অন্ধকারে তারা ২ টি জীপ ও ১ টি ডজ গাড়ীতে চড়ে ঝিনেদার দিক পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধারা ঠিক পেয়ে ওদের পথ অনুসরণ করে। গাড়াগঞ্জের ব্রীজের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা গর্ত খুড়ে সেটা ঢেকে রেখেছিল। পাকসেনারা তা জানতোনা। তাদের গাড়ী দুটো গর্তে পড়ে গিয়ে মেজর শোয়েবসহ শত্রুসেনারা মারা যায়। বাকীরা আহত অবস্থায় পাশ্ববর্তী গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। কিমত্ম সজাগ মুক্তিযোদ্ধা, স্বেচ্ছাসেবক ও জনগণ তাদের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। ১ লা এপ্রিল কুষ্টিয়া সম্পূর্ণরুপে শত্রুমুক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে চলে যায়। এই যুদ্ধে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং অনেকে আহত হন। পুর্ব নির্দেশ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী কুষ্টিয়ায় অধিকৃত সমসত্ম অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও গাড়ী ৩ এপ্রিল ভোরে চুয়াডাঙ্গায় পাঠিয়ে দেন।

ঐদিন চুয়াডাঙ্গায় ফরাসী টেলিভিশন কর্পোরেশনের ভ্রাম্যমান দল এসে হাজির, তারা মেজর ওসমান চৌধুরীর সাক্ষাৎকারে গ্রহনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সে সময় পর্যমত্ম একমাত্র বিবিসি ও আকাশবাণী ছাড়া আর কোথাও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য প্রকাশ পায়নি। দীর্ঘ ১৫ মিনিট ধরে ওসমান চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। ঠিক এমনি সময় চুয়াডাঙ্গার উপর পাকিসত্মান বিমান বাহিনীর বিমান হামলা শুরু হয়। বিমানে আর মাটিতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ চলতে থাকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। এই সুযোগে ফরাসী টিভি সদস্যরা সে চিত্র বন্দী করে রাখেন। বাংলার মাটিতে নিক্ষিপ্ত হলো প্রথম নাপাম বোমা। এদিন কুষ্টিয়া শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় এ বোমায় ক্ষত-বিক্ষত হলো বাংলার পবিত্র মাটি। কুষ্টিয়া শহরের যত্রতত্র বোমা এবং হেলিকপ্টারের মেশিন গানের আক্রমন চললো। মুক্তিযোদ্ধারা সামান্য হাতিয়ার নিয়ে গুলি চালালো পাকিস্তানী বিমান দস্যুদের উপর। পাকসেনারা শোচনীয় পরাজয়ের পর কুষ্টিয়া পূর্ণদখলের জন্য সচেষ্ট হয়। আকাশ ও জলপথে যশোর সেনানিবাসে ব্যাপক সৈন্য ও অস্ত্র নিয়ে আসা হয়। এ সময় পাকবাহিনীর একটি দল আরিচা থেকে জলপথে ১১ এপ্রিল কুষ্টিয়ায় আসে। সামান্য সংখ্যক অস্ত্র সাথে নিয়ে নায়েব সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে একদল মক্তিযোদ্ধা গোয়ালন্দে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাদের উপর নির্দেশ ছিল, পাকসেনারা যেন কোনমতেই পদ্মার এপাড়ে অবতরণ করতে না পারে।

১৩ এপ্রিল অগ্রগামী সৈন্যের সাথে পদ্মার পাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র সংঘর্ষ হয়। এতে পাকবাহিনীর একটি জাহাজ ডুবে যায় এবং তারা উত্তর দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। নগরবাড়ীতে অবতরণ করে পাকসেনারা তীব্র গতিতে পাবনার দিকে অগ্রসর হয়। ভেড়ামারায় অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে প্রচন্ড গুলী বিনিময়ের পর পাকসেনারা ভেড়ামারা এলাকায় অবতরণ করে। ঐ কমান্ডের দায়িত্বে ছিলেন সুবেদার মেজর মোজাফ্ফর। তিনি বাধ্য হয়ে তার সেনাদল নিয়ে পিছু হটে যায়। এ সময় ঝিনাইদহে তাদের পতন হয়। দীর্ঘ ১৭ দিন মুক্ত থাকার পর কুষ্টিয়া পুনরায় শত্রুদের হাতে চলে যায়। এর পর পাকসেনারা শহরে প্রবেশ করেই অগ্নিসংযোগ, গণহত্যা এবং ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে যায়। সে সময় শহরেও লোকসংখ্যা খুবই কম ছিল। যারা ছিল তারা পাক সেনার হাতে নিহত হন। পাকসেনারা বাঙ্গালীদের বাড়ি বেছে বেছে অগ্নিসংযোগ করে। এর পর ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে সারাদেশকে শত্রু মুক্ত করতে এম এন এ,এমসিএ‘র ভোটের মাধ্যমে গঠিত জোনাল কাউন্সিল চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়।

বেছে বেছে যুবকদের বাছাই করে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেকটরে তাদের প্রেরণ করা হয়। কুষ্টিয়ার বিভিন্ন রনাঙ্গনে প্রতিরোধ বাহিনীর পরাজয়ের পর এ জেলার স্বাধীনতার স্বপক্ষে রাজনৈতিক নেতা, ছাত্রনেতা, সেনাবাহিনীর সদস্য, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র, যুবক, মুক্তিকামী হাজার হাজার মানুষ দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। ১৭ এপ্রিল বিকেলে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার(পরবর্তিতে মুজিবনগর) আম্রকাননে ১০ এপ্রিল তারিখে গঠিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহন ও পরিচিতি অনুষ্ঠান অনুষ্টিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা ৮ নং সেক্টরের অধীন ছিল। মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ৮ নং সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১০ ডিসেম্বর সকালে কুষ্টিয়া শহরের দক্ষিণে চৌড়হাস বিটিসি তামাক ক্রয় কেন্দ্রের কাছে জিকে ক্যানেলের ব্রীজের উত্তর পাশে মেইন রাস্তার পাক সৈন্যের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী-মিত্র বাহিনী যৌথভাবে পাকিস্তানবাহিনীর সাথে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এখানেও মিত্র বাহিনীর ৭০ জন শহীদ হন। ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত কুষ্টিয়া জেলার সমস্ত এলাকা স্বাধীন ও শত্রু মুক্ত হয়। ১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া শহর, পোড়াদহ, মিরপুর, ভেড়ামারা এলাকা স্বাধীন শত্রুমুক্ত হয়। সেদিনের ধবংসলীলা কুষ্টিয়া শহরে আজও স্মৃতি বহন করে। এপ্রিল মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সর্বমোট ২২ টি ছোটবড় যুদ্ধ শেষে কুষ্টিয়া ১১ ডিসেম্বর শত্রু মুক্ত হয়েছিল। শত্রুমুক্ত কুষ্টিয়াতে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের জোনাল চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ চৌধুরী কুষ্টিয়া কালেক্টরেট চত্বরে অফিসিয়ালী জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে জোনাল কাউন্সিলের সেক্রেটারী এম শামসুল হক কে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বভার দেন। মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়ার কবি, ছাত্র, সাহিত্যিক,শিল্পী, লেখকের ভুমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।

(তথ্য সুত্র- আব্দুল হান্নানের ‘‘মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়া’’, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও সাংবাদিক নূর আলম দুলাল সংগৃহিত)

Add comment

কুষ্টিয়া সম্পর্কিত তথ্য

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন