ম. আ. রহিম (জন্মঃ- ৮ জানুয়ারি, ১৯৩১ মৃত্যুঃ- ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭) দেশ স্বাধীনের পর জনগনের প্রত্যক্ষ ভোটে কুষ্টিয়া পৌরসভার নির্বাচিত প্রথম এবং পরপর দুই বারের চেয়ারম্যান। উল্লেখ্য, ব্যক্তি জীবনে অমায়িক সজ্জন ও সদালাপী ম. আ রহিম ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জন নির্বাচিত পৌর চেয়ারম্যান। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি তিনি কুষ্টিয়া শহরের আড়ুয়াপাড়ার বিশিষ্ট সমাজসেবক জেহের আলী মন্ডল ও ময়জান নেছার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
ছোট বেলা থেকেই তিনি সমাজ সেবামূলক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে সক্ষম হন। পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি মোহিনী মিল রঙ্গমঞ্চ ও পরিমল থিয়েটারের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু নাটকেও তিনি সফলভাবে অভিনয় করেন। ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিনি “পাকিস্তান যাদুকর পরিষদ” এর রাজশাহী বিভাগীয় প্রতিনিধি ছিলেন (কুষ্টিয়া তখন রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত ছিল)। সে সময় পাকিস্তানের খ্যাতনামা যাদুশিল্পী আলাদীনের ছাত্র হিসাবে তিনি কুষ্টিয়ার বিভিন্ন মঞ্চে ম্যাজিক প্রদর্শন করেন।
১৯৬০-৬১ সময়ে তিনি পাঠাগার, সাংস্কৃতি ও সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসাবে “মিতালী পরিষদ” প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত কুষ্টিয়া ট্রান্সপোর্ট সিন্ডিকেট এর সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত বিআরটিসি-র খুলনা বিভাগীয় পাবলিক ডাইরেক্টর ছিলেন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ব্যবসায়ী সংগঠনে জড়িত থাকার পাশাপাশি তিনি জনপ্রতিনিধি হিসেবে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন।
১৯৫২ সাল থেকে তিনি একাধিক মেয়াদে পৌরসভার ওয়ার্ড কমিশনারে ছিলেন। এছাড়াও ১৯৬৪’র ফেব্র“য়ারি থেকে ১৯৭১ এর মার্চ পর্যন্ত তিনি মিলপাড়া ওয়ার্ড চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন এবং দুই দফায় ১৯৭৪ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত কুষ্টিয়া পৌরসভার নির্বাচিত পৌর চেয়ারম্যান ছিলেন।
স্বাধীনতা পরবর্তি যখন সারাদেশের ন্যায় কুষ্টিয়া শহরও একটু একটু করে যখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় নিমজ্জিত হচ্ছে তখন এখানকার প্রায় সকল শ্রেনীর মানুষই জানতেন পৌরসভা মানেই ম. আ রহিম। সেই ১৮৬৯ সালে কুষ্টিয়া পৌরসভার প্রতিষ্ঠা হবার প্রথম দিকে তৎকালীন বৃটিশ আমলে লড সাহেবের প্রতিনিধিরাই পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
এরপর শহরের বিশিষ্টজনদের মধ্যে থেকে একজনকে স্থানীয়রা কন্ঠভোটের মাধ্যমে মনোনীত করে জেলার সর্বোচ্চ কর্তার কাছে পাঠাতেন তিনি তাকে পৌর কর্ণধারের পদটিতে আসীন করতেন। এভাবেই চলেছে বহুকাল। এরপর ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হবার পর বাঙ্গালীরা তাদের অধিকার অর্জন করে। দেশ স্বাধীন হবার যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটিকে সাজাতে আপাততঃ একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা দিয়ে পরিচালিত হয়েছে সকল কিছু। কুষ্টিয়া পৌরসভাও চলেছে। তবে এই কন্ঠভোটের সময় শহরের এক সময় সবচেয়ে জাকজমকপুর্ণ এলাকা মিলপাড়া ওয়ার্ডের বাসিন্দা ছিলেন ম. আ রহিম।
ছাত্রজীবন থেকে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে নিজেকে আত্মনিয়োগ। এর পর ছাত্র রাজনীতি। পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম এবং সর্বপরি এই শহরের সাংস্কৃতিক চর্চ্চার প্রতিষ্ঠা মুলত ম, আ রহিমের পরিবার থেকেই এসেছে। কেননা পিতা জেহের আলী মন্ডলও একজন বাঙ্গালী সাংস্কৃতিক চর্চ্চার ধারক-বাহক ছিলেন। অপরদিকে মাতৃকুলেও একই পরিচয় মেলে। যখন সিনেমা, ডিশ,সিডি বা আকাশ বিনোদনের কোন বালাই ছিলনা তখন এই শহরের মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা পাশাপাশি সাংস্কৃতিক মুক্তিতে এই পরিবারটি মঞ্চ নাটক, গানসহ বিভিন্ন বাঙ্গালী উৎসব পার্বণ্যে নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছে অকাতরে। এই পরিবারে বেড়ে উঠা ম, আ রহিম।
শৈশব-কৈশর পেরিয়ে যখন যৌবনে পদার্পণ করেছে তখনই তিনি দেখেছেন একটি প্রগতিশীল পরিবারে সাংস্কৃতিক চর্চ্চার কি ডামাডোল। তিনিও তা থেকে দুরে থাকেননি। এক সময় জনসেবায় নেমে যান, ম, আ, রহিম। মিলপাড়া ওয়ার্ডের কমিশনার নির্বাচিত হন তিনি। নিজের জন্য কোন কিছু নয়, নেহাত এলাকার মানুষের পানিয় জল থেকে শুরু করে পয়ঃনিষ্কাশনে সমস্যা নিরসনে প্রতিনিধিত্ব করেন নগর ভবনে কর্তা ব্যক্তিদের সাথে। এ ভাবে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সফলতায় ম, আ রহিম পর পর কয়েকবার ওই ওয়ার্ডের কমিশনার নির্বাচিত হন।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশে সারাদেশে পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশনসহ সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরাসরি জনগনের ভোটের আওতা ভুক্ত করা হয়। কুষ্টিয়া পৌরসভায় ম, আ রহিম হ্যারিকেন প্রতিক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দীতা করেন। বিপুল ভোট পেয়ে ম, আ রহিম কুষ্টিয়া পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর পর থেকে আর কেউ তাকে পেছনে ফেলতে পারেনি। এর পর থেকে এক টানা ১৯৮২ সাল পর্যন্ত জনপ্রিয় চেয়ারম্যান হয়ে কুষ্টিয়া পৌরসভার দায়িত্বপালন করেন। তার সময়ে কুষ্টিয়া পৌরসভার পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, মশক নিধন,সড়ক বাতিসহ বেশ কিছু উন্নয়নমুলক কাজের সুত্রপাত শুরু হয়। শুধু তাই নয় ব্যক্তি জীবনেও ম, আ রহিম ছিলেন একজন অতিশয় সজ্জন, অমায়িক ও সর্বজন শ্রদ্বেয় ব্যক্তি। তার কথায় ও কাজে কেউ কোন দিন কষ্ট পেয়েছেন বা দুঃখ পেয়েছেন এমন মানুষ এই শহরে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
১৯৮৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তিনি চিকিৎসারত অবস্থায় ঢাকার পি.জি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মৃত্যুকালে স্ত্রী, দুই পুত্র, দুই কন্যা রেখে যান।
তার জ্যেষ্ঠ পুত্র মোঃ আখতারুজ্জামান ব্যবসায়ী ও পরিচালক, দি চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি এবং মন্ডল ফিলিং স্টেশন এর মালিক। কনিষ্ট পুত্র হাসান জামান লালন, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের ছাত্র সংসদের সাবেক জি.এস ছিলেন এবং তিনি ১৯৯৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ভারতের দার্জিলিংয়ের এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। দি চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি এর সাবেক পরিচালক মোঃ রাকিবুজ্জামান সেতুর দাদা।