বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

গোকুল মেধ
গোকুল মেধ

মহাস্থানগড় বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি। প্রসিদ্ধ এই নগরী ইতিহাসে পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রনগর নামেও পরিচিত ছিল। এক সময় মহাস্থানগড় বাংলার রাজধানী ছিল। যিশু খ্রিষ্টের জন্মেরও আগে অর্থাৎ প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে এখানে সভ্য জনপদ গড়ে উঠেছিল প্রত্নতাত্ত্বিক ভাবেই তার প্রমাণ মিলেছে। ২০১৬ সালে এটি সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা হয়।

প্রাচীর বেষ্টিত এই নগরীর ভেতর রয়েছে বিভিন্ন আমলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এ স্থান পরাক্রমশালী মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন শাসকবর্গের প্রাদেশিক রাজধানী ও পরবর্তীকালে হিন্দু সামন্ত রাজাদের রাজধানী ছিল। তৃতীয় খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে পঞ্চদশ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অসংখ্য হিন্দু রাজা ও অন্যান্য ধর্মের রাজারা রাজত্ব করেন। মহাস্থানগড়ের অবস্থান বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় । বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৩ কি.মি. উত্তরে করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে গেলে এই শহরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়৷।

ইতিহাস

বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬৩৯ থেকে ৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে পুন্ড্রনগরে এসেছিলেন। ভ্রমণের ধারাবিবরণীতে তিনি তখনকার প্রকৃতি ও জীবনযাত্রার উল্লেখ করে বর্ণনা দেন। বৌদ্ধ শিক্ষার জন্য প্রসিদ্ধ হওয়ায় চীন ও তিব্বতথেকে ভিক্ষুরা তখন মহাস্থানগড়ে আসতেন লেখাপড়া করতে৷ এরপর তাঁরা বেরিয়ে পড়তেন দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। সেখানে গিয়ে তাঁরা বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষার বিস্তার ঘটাতেন৷

সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণসেন (১০৮২-১১২৫) যখন গৌড়ের রাজা ছিলেন তখন এই গড় অরক্ষিত ছিল। মহাস্থানের রাজা ছিলেন নল যার বিরোধ লেগে থাকত তার ভাই নীল এর সাথে। এসময় ভারতের দাক্ষিণাত্যের শ্রীক্ষেত্র নামক স্থান থেকে এক অভিশপ্ত ব্রাহ্মণ এখানে অসেন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে। তিনি পরশু বা কুঠার দ্বারা মাতৃহত্যার দায়ে অভিশপ্ত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনিই এই দুই ভাইয়ের বিরোধের অবসান ঘটান এবং রাজা হন। এই ব্রাহ্মণের নাম ছিল রাম। ইতিহাসে তিনি পরশুরাম নামে পরিচিত। কিংবদন্তি অনুযায়ী তিনি ছিলেন একজন অত্যাচারী।

রাজা পরশুরামকে উচ্ছেদ করে ইসলাম ধর্মের শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে আসেন ফকির বেশি আধ্যাত্মিক শক্তিধারী দরবেশ হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র:) এবং তার শীষ্য। ধর্ম প্রচারক শাহ্ সুলতান বলখী (রঃ) সম্পর্কে রয়েছে আশ্চর্য কিংবদন্তি। কথিত আছে, তিনি মহাস্থানগড় অর্থাৎ প্রাচীন পুন্ড্রনগরে প্রবেশ করার সময় করতোয়া নদী পার হয়েছিলেন একটা বিশাল মাছের আকৃতির নৌকার পিঠে চড়ে। মহাস্থানগড় পৌছে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন, প্রথমে রাজা পরশুরামের সেনাপ্রধান, মন্ত্রি এবং কিছু সাধারণ মানুষ ইসলামের বার্তা গ্রহণ করে মুসলিম হয়। এভাবে পুন্ড্রবর্ধনের মানুষ হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকলে রাজা পরশুরামের সাথে শাহ সুলতানের বিরোধ বাধে এবং এক সময় সুলতান বলখী পুন্ড্রবর্ধনের শেষ রাজা পরশুরামকে (১২০৫-১২২০) যুদ্ধে পরাজিত করে পুন্ড্রবর্ধন জয় করেন।

ভূগোল

পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী মহাস্থানগড়ের অবস্থান বগুড়া শহর থেকে থেকে ১৩ কিলোমিটার(৬.৮ মাইল) উত্তরে বগুড়া রংপুর মহাসড়কের পাশে। মনে করা হয় এখানে শহর পত্তনের মূল কারণ এটি বাংলাদেশের একটি অন্যতম উচ্চতম অঞ্চল। এখানের ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৬ মিটার (১১৮ ফুট) উঁচু, যেখানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৬ মিটার (২০ ফুট) উঁচু। এছাড়া এই স্থানটি বেছে নেওয়ার আরেকটি কারণ হল করতোয়া নদীর অবস্থান ও আকৃতি। নদীটি ১৩ শতকে বর্তমান গঙ্গা নদীর তিনগুণ বেশি প্রশস্ত ছিল। মহাস্থানগড় বরেন্দ্র অঞ্চলের লাল মাটিতে অবস্থিত যা পলিগঠিত অঞ্চল হতে কিছুটা উঁচু। ১৫-২০ মিটার উপরের অঞ্চলগুলোকে বন্যামুক্ত ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চল বলে ধরা যায়।

আবিষ্কার

মহাস্থানগড়ের ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত ও উদঘাটন করার ক্ষেত্রে একাধিক ব্যক্তির অবদান রয়েছে। ১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিলটন প্রথম মহাস্থানগড়ের অবস্থান চিহ্নিত করেন। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ আলেক্সান্ডার কানিংহাম প্রথম এই প্রাচীন ঐতিহাসিক নগরীকে পুন্ড্রবর্ধনের রাজধানীরূপে চিহ্নিত করেন। অনেক পর্যটক ও পন্ডিত ব্যক্তি, বিশেষত সি. জে. ও’ডোনেল, ই. ভি. ওয়েস্টম্যাকট ও হেনরী বেভারীজ এই শহরতলি এলাকাটি পরিদর্শন করেন এবং তাঁদের প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করেন। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে সন্ধান মেলে ব্রাহ্মী লিপির। সেই লিপিতে পুণ্ড্রনগরের প্রাদেশিক শাসক সম্রাট অশোক দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে রাজভান্ডার থেকে খাদ্যশস্য ও অর্থ সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দেন। এসব তথ্য উপাত্ত থেকে প্রসিদ্ধ এই নগরীর প্রাচীনতমের প্রমাণ মেলে।

দুর্গস্থাপনা

প্রাচীন শহরের কেন্দ্রেস্থিত দুর্গটি উপর থেকে দেখতে আয়তাকার ছিল যা উত্তর-দক্ষিণে ১.৫২৩ কিলোমিটার (০.৯৪৬ মাইল) ও পূর্ব-পশ্চিমে ১.৩৭১ কিলোমিটার (০.৮৫২ মাইল) পর্যন্ত বিস্তৃত। এর প্রতি পাশে উঁচু ও প্রশস্ত সুরক্ষা প্রাচীর ছিল। দুর্গের আয়তন প্রায় ১৮৫ হেক্টর। এককালের প্রশস্তা নদী করতোয়া এর পূর্বপার্শ্বে প্রবাহিত হত। ১৯২০ সাল পর্যন্ত খননকার্যের পূর্বে দুর্গের উচ্চতা আশেপাশের অঞ্চলের চেয়ে ৪ মিটার বেশি ছিল এবং বেশ কয়েকটি উঁচু মাটির আস্তরে দাগাঙ্কিত ছিল। রক্ষাপ্রাচীরটি কাদামাটির তৈরি প্রাচীরের মতো দেখতে যা বহু স্থানে বলপূর্বক ভাঙার চেষ্টা দেখা যায়। প্রাচীরটি আশেপাশের অঞ্চলের চেয়ে ১১-১৩ মিটার (৩৬-৪৩ ফুট) উঁচু। এর দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি মাজার ছিল। এছাড়া পরবর্তীকালের (১৭১৮-১৯) নির্মিত একটি মসজিদও রয়েছে। বর্তমানে দুর্গের ভিতরে কয়েকটি ঢিবি ও নির্মাণ নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে জিয়ত কুণ্ড (একটি কূপ যাতে জীবন প্রদানের শক্তি আছে বলে বিশ্বাস করা হয়), মানকালীর ধাপ(মানকালীর পবিত্র স্থান),পরশুরামের বাসগৃহ (রাজা পরশুরামের প্রাসাদ), বৈরাগীর ভিটা (সন্ন্যাসিনীদের আখড়া), খোদার পাথর ভিটা (ঈশ্বরকে অর্পিত প্রস্তরখণ্ড), মুনির ঘোন (একটি ক্ল্লো) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি প্রবেশদ্বার রয়েছে যেমন কাঁটা দুয়ার (উত্তরে), দোরাব শাহ তোরণ (পূর্বে), বুড়ির ফটক (দক্ষিণে), তাম্র দরজা (পশ্চিমে )। উত্তর-পূর্ব কোণে কয়েকটি ধাপ (পরে সংযুক্ত) রয়েছে যা জাহাজঘাটা পর্যন্ত গিয়েছে। জাহাজঘাটার কিছুটা সামনে করতোয়া নদীর তীরে গোবিন্দ ভিটা (গোবিন্দের মন্দির) অবস্থিত। এর সামনে স্থানীয় জাদুঘর রয়েছে যেখানে উল্লেখযোগ্য কিছু নিদর্শন প্রদর্শিত হয়েছে। এর পাশে একটি রেস্ট হাউজ রয়েছে।

নগরের অবকাঠামো

দুর্গকাঠামো ছাড়াও সেখানে প্রায় শখানেক ঢিবি ৯ কি.মি. ব্যাসার্ধের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে।

খননকৃত ঢিবিঃ-

  1. গোবিন্দ ভিটা, দুর্গের উত্তর পূর্ব কোণে অবস্থিত একটি মন্দির
  2. খুল্লনার ধাপ, একটি মন্দির
  3. মঙ্গলকোট, মহাস্থানগড় জাদুঘর থেকে ১.৬ কিলোমিটার দক্ষিণ বা দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত একটি মন্দির।
  4. গদাইবাড়ি ধাপ, খুল্লনার ধাপ থেকে ১ কিলোমিটার দক্ষিণে একটি মন্দির
  5. তোতারাম পন্ডিতের ধাপ, দুর্গের ৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত একটি আশ্রম
  6. নরপতির ধাপ (ভাসু বিহার), তোতারাম পণ্ডিতের ধাপ হতে ১ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত একগুচ্ছ আশ্রম
  7. গোকুল মেধ, (লখীন্দরের বাসরঘর), দুর্গের তিন কিলোমিটার দক্ষিণে একটি মন্দির
  8. স্কন্ধের ধাপ, গোকুল মেধের ২ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে একটি মন্দির
  9. বৈরাগীর ভিটা, ১৯২৮-২৯ সালে খনন করা বৈরাগীর ভিটায় দুটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়।

প্রধান অখননকৃত ঢিবিঃ-

  1. শীলাদেবীর ঘাট
  2. চুনোরু দিঘি ধাপ
  3. কৈবিল্কি ধাপ
  4. জুরাইনতলা
  5. পরশুরামের শোভাবাতি
  6. বলাই ধাপ
  7. প্রচীর ঢিবি
  8. কাঞ্জির হাড়ি ধাপ
  9. লহনার ধাপ
  10. খোজার ঢিবি
  11. দোলমঞ্চ ঢিবি
  12. ধনিকের ধাপ
  13. মন্দিরির দরগাহ
  14. বিষমর্দন ঢিবি
  15. মলিনার ধাপ
  16. মলপুকুরিয়া ধাপ
  17. যোগীর ধাপ
  18. পদ্মবতীর ধাপ
  19. কানাই ধাপ
  20. দুলু মাঝির ভিটা
  21. পদ্মার বাড়ি
  22. ওঝা ধন্বন্তরির ভিটা
  23. রাসতলা ধাপ
  24. শশীতলা ধাপ
  25. চাঁদের ধাপ
  26. সিন্ধিনাথ ধাপ
  27. শালিবাহন রাজার কাচারিবাড়ি ঢিবি
  28. ধনভাণ্ডার ঢিবি
  29. কাঁচের আঙ্গিনা
  30. মঙ্গলনাথের ধাপ
  31. ছোট টেংরা/ বাবুর ধাপ/ কেদার ধাপ
  32. সন্ন্যাসীর ধাপ
  33. দশহাতিনা ধাপ

খননকার্য

মহাস্থানগড়ের প্রথাগত প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার কে. এন. দীক্ষিত এর তত্ত্বাবধানে ১৯২৮-২৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম শুরু করা হয়। তখন জাহাজঘাটার আশেপাশে মুনির ঘোন আর বৈরাগীর ভিটা পরিদর্শন করা হয়। বৈরাগীর ভিটা আর গোবিন্দ ভিটায় ১৯৩৪-৩৬ খ্রিষ্টাব্দে খননের কাজ স্থগিত করা হয়। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে সন্ধান মেলে ব্রাহ্মী লিপির। সেই লিপিতে পুণ্ড্রনগরের প্রাদেশিক শাসক সম্রাট অশোক দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে রাজভান্ডার থেকে খাদ্যশস্য ও অর্থ সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দেন। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে মাজার, পরশুরামের প্রাসাদ, মানকালীর ধাপ, জিয়ৎ কুণ্ড ও উত্তরপাশের প্রাচীরের নিকটে খননকাজ চালানো হয়। পূর্ব ও উত্তরপাশের রক্ষাপ্রাচীরে পরবর্তীধাপের খননকাজ বিক্ষিপ্তভাবে চালানো হয় যদিও তখনও চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি।

এসব উৎখননের প্রাথমিক প্রতিবেদন ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। প্রায় দু’দশক পর ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে খননকাজ পুনরায় শুরু করা হয় এবং ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছরই খননকাজ চলতে থাকে। এ সময় খননকাজ মাজারের নিকটবর্তী এলাকা এবং উত্তর ও পূর্ব দিকের রক্ষা-প্রাচীর সংলগ্ন অংশে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু এ পর্যায়ে সম্পন্ন কাজের পরিমাণ এলাকাটির বিশালত্বের তুলনায় খুবই নগণ্য ছিল। এ স্থানটির ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক অনুক্রম এখনও অজ্ঞাত। এ প্রত্নস্থল ও অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস পুনর্গঠন এবং প্রাচীন নগরটির সংগঠন সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য একটা ব্যাপক অনুসন্ধান কাজ পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘকাল ধরে অনুভূত হচ্ছিল। ফলে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির (১৯৯২) অধীনে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে বাংলাদেশী ও ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিকবিদগণ একটি যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করে। তখন থেকে পূর্ব দিকের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের মধ্যভাগ সন্নিহিত স্থানে প্রতিবছর প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন কাজ পরিচালিত হতে থাকে। ইতঃপূর্বে সুরক্ষিত নগরের বাইরে ভাসুবিহার, বিহার ধাপ, মঙ্গলকোট ও গোদাইবাড়ির ন্যায় কয়েকটি স্থানেও বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক খননকার্য পরিচালিত হয়েছে। নগরটিতে উৎখননকালে কয়েকটি স্থানে প্রত্নস্থলের মূল মাটি পর্যন্ত খনন করা হয়েছে। এর মধ্যে ফ্রান্স-বাংলাদেশ মিশন কর্তৃক পরিচালিত সাম্প্রতিক উৎখনন ১৮টি নির্মাণ স্তর উন্মোচন করেছে। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে অদ্যাবধি (ফ্রান্স-বাংলাদেশ উদ্যোগসহ) বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত উৎখননের ফলে নিম্নবর্ণিত সাংস্কৃতিক অনুক্রম উদ্ঘাটিত হয়েছে।

প্রথম যুগ: এ পর্যায়ে রয়েছে প্রাক-মৌর্য সংস্কৃতির স্মারক হিসেবে খ পর্যায়ের বিপুল পরিমাণ উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ পাত্র, রুলেটেড পাত্র, কালো ও লাল রঙের পাত্র, কালো প্রলেপযুক্ত পাত্র, ধূসর বর্ণের পাত্র, পাথরের যাতা, মাটির তৈরি মেঝেসহ মাটির ঘর (রান্নাঘর), চুলা এবং খুটির গর্ত। উত্তরাঞ্চলীয় কালো মসৃণ পাত্র সর্বনিম্ন স্তরে অধিক পরিমাণে পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে থালা, কাপ, গ্লাস এবং গামলা প্রধান। এ স্তরে অত্যন্ত সীমিত এলাকায় একটি ইট বিছানো মেঝে পাওয়া গেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মেঝের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন দেয়াল পাওয়া যায়নি। সম্ভবত প্লাইস্টোসিন ভূভাগের উপর এখানে সর্বপ্রথম বসতি গড়ে উঠেছিল। এর উপরের বসতি স্তরের তেজস্ক্রিয় কার্বন তারিখ পাওয়া গেছে খ্রিস্টপূর্ব চার শতকের শেষ ভাগ। এ থেকে ধারণা করা যায়, এ স্তরের বসতি প্রাক-মৌর্য যুগের। এই আদি বসতি স্তর নন্দ বা প্রায় ঐতিহাসিক সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত কিনা তা নির্ণয় করা প্রয়োজন।

দ্বিতীয় যুগ: এ যুগে প্রাপ্ত প্রত্নসম্পদের মধ্যে রয়েছে ভাঙ্গাঁ টালি (জানামতে এ ধরনের ছাদের জন্য ব্যবহূত টালির প্রাচীনতম নিদর্শন), মাটির দেয়াল নির্মাণে মিশ্রণ বা বন্ধনের জন্য ব্যবহূত ইটের টুকরা (মাঝে মাঝে গৃহস্থালি কাজেও যেমন চুলার স্থান, পোড়ামাটির পাতকূয়া), উত্তরাঞ্চলীয় কালো মসৃণপাত্র, ঈষৎ লাল বা ঈষৎ হলুদ রঙের সাধারণ পাত্র, রিং স্টোন, ব্রোঞ্জের আয়না, ব্রোঞ্জের প্রদীপ, ছাuঁচ ঢালা মুদ্রা, পোড়ামাটির ফলকচিত্র, পোড়ামাটির জীবজন্তু, অর্ধমূল্যবান পাথরের গুটিকা বা পুঁতি এবং পাথরের যাতা। কয়েকটি তেজস্ক্রিয় কার্বন তারিখ (খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৬-১৬২, ৩৭১-১৭৩ অব্দ) এবং সাংস্কৃতিক দ্রব্য এ পর্যায়কে মৌর্য যুগের অন্তর্ভুক্ত করে।

তৃতীয় যুগ: এ যুগ মৌর্যোত্তর (শূঙ্গ-কুষাণ) পর্বের অন্তর্ভুক্ত। এ যুগে বৃহদায়তনের ও অপেক্ষাকৃত ভালভাবে সংরক্ষিত ইটের উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ, ইট বিছানো মেঝে, খুঁটির গর্ত, পোড়ামাটির পাতকূয়া, শূঙ্গ বৈশিষ্ট্যযুক্ত প্রচুর পোড়ামাটির ফলক, অর্ধমূল্যবান পাথরের (এ্যাগেট কার্নেলিয়ন, কোয়ার্টজ) পুঁতি, সুর্মা লাগানোর দন্ড, ছাপাংকিত রৌপ্য মুদ্রা, রূপার বালা, ঢালাই করা তাম্র মুদ্রা, পোড়ামাটির মন্দির চূড়া, ঈষৎ লাল বা হলুদ রঙের প্রচুর পরিমাণ সাধারণ পাত্র (বিশেষত থালা, কাপ, গামলা) এবং ধূসর মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। মোটা বুননের উত্তরাঞ্চলীয় কালো মসৃণ পাত্র মৌর্যস্তরের তুলনায় এ স্তরে কম। কয়েকটি তেজস্ক্রিয় কার্বনের ক্রমাঙ্ক স্তর হলো খ্রিস্টপূর্ব ১৯৭-৪৭ অব্দ, খ্রিস্টপূর্ব ৬০ অব্দ-১৭২ খ্রিস্টাব্দ, খ্রিস্টপূর্ব ৪০ অব্দ-১২২ খ্রিস্টাব্দ।

চতুর্থ যুগ: এ সময়ে কুষাণ-গুপ্ত যুগের নিদর্শনাদি উন্মোচিত হয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ কুষাণ মৃৎপাত্রের টুকরা এবং সমসাময়িক কালের সুনির্দিষ্ট শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত প্রচুর পোড়ামাটির ফলকচিত্র এ যুগের আবিষ্কৃত প্রত্নসম্পদ। মৃৎপাত্রের প্রধান ধরন হলো খোদাই করা নকশাসহ হাতলওয়ালা রান্নার পাত্র, পিরিচ, গামলা, পিচকারি এবং ঢাকনি। উপরের এবং নিচের স্তরের তুলনায় স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ এ অংশে কম। স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে আছে ভাঙ্গা ইটের টুকরা। অন্যান্য সাংস্কৃতিক সামগ্রী হলো পোড়ামাটির গুটিকা বা পুঁতি, গামলা, পাথর এবং কাঁচের গুটিকা বা পুঁতি, কাঁচের চুড়ি এবং পোড়ামাটির সিলমোহর।

পঞ্চম যুগ: এ যুগ গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগের পরিচয় বহন করে। তেজস্ক্রিয় কার্বন পদ্ধতিতে ৩৬১ থেকে ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ক্রমাঙ্কিত তারিখ নির্দেশিত হয়েছে। এ পর্যায়ে দুর্গ-নগরীর সন্নিকটে পরবর্তী গুপ্তযুগের গোবিন্দ ভিটা নামে পরিচিত মন্দিরের ইটনির্মিত বিশাল কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ এবং নগরে ইটের তৈরী ঘরবাড়ি, মেঝে ও রাস্তার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও রয়েছে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রীতির পোড়ামাটির ফলক, সিলমোহর, কাঁচ ও প্রায়-মূল্যবান পাথরের গুটিকা বা পুঁতি, পোড়ামাটির গোলক ও চাকতি, তামা ও লোহার দ্রব্য এবং ছাপ দিয়ে নকশা করা পাত্রসহ বিপুলসংখ্যক প্রত্নসম্পদ।

ষষ্ঠ যুগ: এ যুগটি নগরের পূর্ব দিকে খোদার পাথর ভিটা, মানকালীর কুন্ড ধাপ, পরশুরামের প্রাসাদ ও বৈরাগীর ভিটার ন্যায় কয়েকটি বিক্ষিপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ দ্বারা পাল যুগের পরিচয় বহন করে। এ পর্যায়টি ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং এ যুগে নগরের বাইরে বহুসংখ্যক বৌদ্ধ ইমারত নির্মিত হয়েছিল। সপ্তম যুগ: মানকালীর কুন্ডে পূর্ববর্তী যুগের ধ্বংসাবশেষের উপর স্থাপিত ১৫ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের ধ্বংসাবশেষ, ফররুখসিয়ার কর্তৃক নির্মিত এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের ধ্বংসাবশেষ এবং চীনা সেলাডন ও এ যুগের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত চকচকে মাটির পাত্রের ন্যায় অপরাপর প্রত্ননিদর্শন দ্বারা মুসলিম যুগের পরিচয় বহন করে। নগরের অভ্যন্তরভাগে বৈরাগীর ভিটা, খোদার পাথর ভিটা, মানকালীর ঢিবি, পরশুরামের প্রাসাদ ঢিবি ও জিয়ৎ কুণ্ড প্রভৃতি প্রত্নস্থল থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব প্রত্নস্থল ছাড়াও ১৯৮৮-৯১ সালে খননকার্যের ফলে নগরটির তিনটি প্রবেশদ্বার, উত্তর ও পূর্ব দিকের রক্ষা-প্রাচীরের উল্লেখযোগ্য অংশ এবং মাযার এলাকার নিকটে একটি মন্দির-স্থাপনা উন্মোচিত হয়েছে।

মহাস্থান প্রত্নস্থলের তিনটি প্রবেশদ্বারের দুটি উত্তর দিকের রক্ষা-প্রাচীরে অবস্থিত। দুর্গের উত্তর-পশ্চিম কোণের ৪৪২ মিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি প্রবেশদ্বার ৫ মিটার প্রশস্ত ও ৫.৮ মিটার দীর্ঘ। অন্যটি ৬.৫ মিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত এবং ১.৬ মিটার প্রশস্ত। প্রবেশদ্বার দুটি প্রাথমিক ও পরবর্তী পালযুগ দুপর্যায়ে ব্যবহূত হয়েছিল। পূর্ব দিকের রক্ষা-প্রাচীরের একমাত্র প্রবেশদ্বারটি প্রায় এর মধ্যস্থলে এবং পরশুরামের প্রাসাদের ১০০ মিটার পূর্বে অবস্থিত এবং প্রায় ৫ মিটার প্রশস্ত। পাল যুগের শেষের দিকে একটি পুরানো প্রবেশদ্বারের ধ্বংসাবশেষের উপর এটি নির্মিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এ প্রবেশদ্বারটি এখনও সম্পূর্ণরূপে উদ্ধার করা যায়নি। সবগুলি প্রবেশদ্বার-স্থাপনায় ভেতর দিকে প্রহরি-কক্ষ এবং রক্ষা-প্রাচীরের বাইরে সম্প্রসারিত বুরুজ রয়েছে।

মাজার এলাকায় উন্মোচিত মন্দির-স্থাপনায় কোন সুসঙ্গত নির্মাণ পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যায় না। পাল শাসনামলে এটি পাঁচটি পর্যায়ে নির্মিত ও পুননির্মিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এ এলাকা থেকে উদ্ধারকৃত প্রত্ননিদর্শনের মধ্যে রয়েছে কয়েকটি বড় আকারের পোড়ামাটির ফলক, খেলনা ও গোলক এবং অলঙ্কৃত ইট ও মাটির পাত্র।

নগরের রক্ষা-প্রাচীরটি ছয়টি পর্যায়ে নির্মিত। সর্বপ্রাচীন পর্যায়ে সম্ভবত মৌর্যযুগ এবং পরবর্তী পর্যায় শূঙ্গ-কুষাণ, গুপ্ত, প্রাথমিক পাল, পরবর্তী পাল ও সুলতানি আমলের সাথে সম্পৃক্ত। এই প্রাচীরগুলি পর্যায়ক্রমে একটির উপর অন্যটি নির্মিত হয়েছে। কাজেই নগরের অভ্যন্তরে পর্যায়ক্রমিক সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা প্রাচীরেও নির্মাণের পর্যায়ক্রমিক স্তর পরিদৃষ্ট হয়। অবশ্য প্রাচীনতম স্তরে নগরটির সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ এবং প্রাচীনতম রক্ষা-প্রাচীরের পারস্পরিক সম্পর্ক এখনও নির্ণয়সাপেক্ষ।

গোবিন্দ ভিটা, লক্ষ্মীন্দরের মেধ, ভাসুবিহার, বিহার ধাপ, মঙ্গলকোট ও গোদাইবাড়ি ধাপ নগরটির বাইরে সন্নিহিত এলাকায় খননকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা। কিন্তু সন্নিহিত গ্রামসমূহে আরও অনেক স্তূপ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রয়েছে, যেখানে প্রাচীন সুরক্ষিত পুন্ড্রনগরের উপকণ্ঠের সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ নিহিত আছে বলে বিশ্বাস করা হয়।

দর্শনীয় স্থান

মহাস্থান গড় বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রাচীন পর্যটন কেন্দ্র। এখানে বহু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। ২০১৬ সালে দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসাবে মহাস্থানগড়ে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে।

দর্শকদের জন্য জ্ঞাতব্যঃ- মহাস্থানগড় বগুড়া থেকে ১৩ কিলোমিটার উত্তরে বগুড়া-ঢাকা বিশ্বরোডের পাশে অবস্থিত। পাশেই করতোয়া নদীর একটি ক্ষীণকায় স্রোতধারা প্রবহমান। রাস্তাটি জাহাহঘাটা ও জাদুঘর অবধি গিয়েছে। ঢাকা থেকে সরাসরি যাওয়ার বাস রয়েছে এবং যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর উপর দিয়ে যেতে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা সময় লাগে। বগুড়া থেকেও বাস পাওয়া যায় এবং স্থানীয় চলাচলের জন্য রিক্সা রয়েছে। এছাড়া ঢাকা বা বগুড়া থেকে ভাড়া গাড়িও পাওয়া যায়। ভাড়া গাড়িতে ভ্রমণ করলে একই পথে পুনরায় চলে আসা যায়, অথবা কেউ চাইলে সেখান থেকে নওগার পাহাড়পুরে সোমপুর মহাবিহার পরিদর্শনে যেতে পারেন।

মাজার শরীফঃ- অনেক ঐতিহাসিক এবং স্থানীয় লোকের মতে এটি হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র:) এর মাজার। মহাস্থান বাস স্ট্যান্ড থেকে কিছুটা পশ্চিমে এ মাজার শরীফ অবস্থিত। শাহ সুলাতান বলখী (র:) ১৪শ শতাব্দির একজন ইসলাম ধর্ম প্রচারক ছিলেন। কথিত আছে মাছ আকৃতির নৌকাতে করে তিনি তার শীষ্যদের নিয়ে বরেন্দ্র ভূমিতে আসেন। সেখান থেকে তার নাম এসেছে মাহিসাওয়ার (মাছের পিঠে করে আগমণকারী) এবং তিনি বল্লখ রাজ্যের রাজার পুত্র ছিলেন বিধায় তাকে শাহ সুলতান বলখী ও বলা হয়। ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেব সৈয়দ রেজা, সৈয়দ তাহির, সৈয়দ আব্দুর রাহ্মান (তিন ভাই) কে এই মাজারকে জামিনদার দেখাশোনার দায়িত্ব প্রদান করেন। স্থানীয় লোকজন শাহ সুলতান মাহিসওয়ারকে খুব শ্রদ্ধা করে। ধর্মপ্রান হাজারো মুসলমান তাদের নানা সমস্যার সমাধান ও মানত করতে এই মাজারে আসেন।

জাদুঘরঃ- বগুড়া থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তরে এবং মহাস্থানগড় থেকে সামান্য উত্তরে গোবিন্দ ভিটার ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থিত এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৭ সালে। প্রথম দিকে ৩ একর জায়গার উপর জাদুঘরের মূল অংশটি থাকলে নানা সময়ে সম্প্রসারিত হয়ে বর্তমানে এর পরিধি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ একরে। মহাস্থান গড় খননের ফলে মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন ও অন্যান্য রাজবংশের হাজার বছরের পুরানো অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন সোনা, রুপা, লোহা, ব্রোঞ্জ, পাথর, কাঁসাসহ বিভিন্ন মূল্যবান ধাতব পদার্থ, পোড়ামাটির তৈরি মূর্তি, কালো পাথরের মূর্তি, বেলে পাথরের মূর্তি, মাটি দিয়ে তৈরি খোদাই করা ইট, স্বর্ণবস্তু, বিভিন্ন শিলালিপি, আত্মরক্ষার জন্য ধারালো অস্ত্র, নিত্যপ্রয়োজনীয় তৈজসপত্র ও নানা ধরনের প্রাচীন অলংকারসহ ইত্যাদি সামগ্রী পাওয়া গেছে যা গড়ের উত্তরে অবস্থিত জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। মহাস্থান গড় ছাড়াও আরও বিভিন্ন স্থানের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এখানে সংরক্ষিত আছে।

খোদার পাথর ভিটাঃ- খোদার পাথর ভিটা মাজারের পূর্বে পাহারে অবস্থিত। আয়তাকার এই বৌদ্ধ মন্দিরটি ছিল পূর্বাভিমুখী। এটি দীর্ঘাকার এবং চৌকাণাকৃতির মর্সণ পাথর যা সাধারণত প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, রাজা পরশুরাম এটি সংগ্রহ করে মসৃণ করে বলী দেয়ার কাজে ব্যবহার করতেন। হিন্দু রমণীগণ এ পাথর দুধ ও সিঁদুর দিয়ে স্নান করাতো। এখনো কেউ কেউ নগ্ন পায়ে এই চৌকাঠটিতে দুধ ঢেলে ভক্তি নিবেদন করেন। এই ভিটার ধ্বংসাবশেষ পাল শাসনামলের প্রথম দিকের (আনুমানিক খ্রিস্টীয় আট শতক) বলে জানা গেছে। ১৯৭০ সালে এ ঢিবি বা ভিটাতে খননকার্য করে একটি মন্দির এবং তার সাথে ছোটখাটো কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়। এই ঢিবির উপরিভাগে গ্রানাইট পাথরের একটি বিশাল চৌকাঠ পাওয়া যায় এবং এ থেকেই স্থানীয় জনগণ ঢিবির এমন অদ্ভুত নামকরণ করেছে। এখানে খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত খোদাইকৃত প্রস্তর খন্ডগুলির মধ্যে একই সারিতে আসীন অবস্থায় তিনটি বৌদ্ধমূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। যা বর্তমানে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে রক্ষিত আছে। এখনও মাটির নিচে চাপা পড়া অবস্থায় আছে প্রত্নস্থলটির কাঠামোর ধংসাবশেষ। শুধু বিশাল চৌকাঠটি এখানে দেখা যায়।

মানকালীর ঢিবিঃ- আজীবক ধর্ম প্রচারক মোক্ষালি গোসালের নির্মিত হয় এই মন্দির। এটি মহাস্থানগড়ের মজা পুকুরের পূর্ব পারে অবস্থিত। ১৯৬৫-৬৬ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্বাবধানে এখানে খননকাজ শরু হয় ও শেষ পর্যন্ত সুলতানী আমলের একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষসহ বেশ কিছু ছোট ছোট প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু আবিষ্কার করা হয়। মসজিদটির আয়তন ২৬.২১ থেকে ১৪.৫৪ মিটার। খনন কাজ চলার সময় মসজিদের নিচে একটি মন্দিরেরও কিছু ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল। মসজিদটিতে কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি তবে মসজিদের অবকাঠামো দেখে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ ধারণা করেন এটি খুব সম্ভবত মুঘল আমলের পূর্বেই নির্মাণ করা হয়েছিল। কিংবদন্তী অনুসারে, এই স্থানে প্রথমে একটি মন্দির নির্মাণ করেন রাজা মানসিংহ ও তার ভাই তানসিংহ। অন্যান্য কিংবদন্তী অনুসারে, এখানে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন ঘোড়াঘাটের জমিদারগণ। এছাড়াও এখানে পাওয়া জৈন প্রতিমা দেখে অনেকেই মনে করেন পূর্বে জৈন ধর্মগুরুদের আবাসস্থল ছিলো স্থানটি।

বৈরাগীর ভিটাঃ- মহাস্থানগড় এর উত্তর-পূর্ব কোনে রাজা পরশুরামের বাড়ি হতে প্রায় ২০০ গজ দূরে অবস্থিত। এই স্তূপটির আয়তন ৩০০*২৫০ ফুট।

স্কন্ধের ধাপঃ- এটি একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। মহাস্থানগড় থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে পাকা সড়কের প্রায় ৫০ মিটার পুবে একটি জলাশয়ের পাশে এই ধাপ অবস্থিত। খ্রিষ্টীয় সাত শতকে কলহন নামে পণ্ডিতের রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থে পুণ্ড্রনগরে একটি কার্তিকের মন্দির ছিল বলে জানা যায়। ধরনা করা হয় স্কন্দের ধাপের এই মন্দিরটি হল কার্তিকের মন্দির। উৎখনন করার কারণে ঢিবির অনেক ক্ষতি সাধিত হয়েছে।

মঙ্গলকোট স্তুপঃ- মহাস্থান গড় হতে ১ কি:মি: পশ্চিমে অবস্থিত।

গোকুল মেধঃ- মহাস্থানগড় হতে দক্ষিণ পশ্চিম কোণে ২ কি:মি: দূরে অবস্থিত।

ট্যাংরা বৌদ্ধ স্তুপঃ- প্রায় ৪৫ ফিট উচ্চতা বিশিষ্ট এই স্তুপ ট্যাংরা নামক স্থানে অবস্থিত।

বিহার ধাপঃ- মহাস্থানগড় হতে ৬ কি:মি: উত্তর পশ্চিম অবস্থিত। স্তুপটি ৭০০*৬০০ ফুট আয়তন।

ভাসু বিহারঃ- মহাস্থানগড় হতে ৭ কি:মি: উত্তর পশ্চিমে এবং বৌদ্ধ বিহার হতে ২ কি:মি: উত্তরে অবস্থিত।

ভিমের জঙ্গলঃ- মহাস্থানগড় এর তিন দিক পরিবেষ্টিত এবং অসংখ্য কালোত্তীর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনা সমৃদ্ধ এই ভিমের জংগল।

কালীদহ সাগরঃ- গড়ের পশ্চিম অংশে রয়েছে ঐতিহাসিক কালীদহ সাগর এবংগড়ের পশ্চিম অংশে রয়েছে ঐতিহাসিক কালীদহ সাগর এবং পদ্মাদেবীর বাসভবন।। কালীদহ সাগর সংলগ্ন ঐতিহাসিক গড় জড়িপা নামক একটি মাটির দূর্গ রয়েছে। প্রাচীন এই কালীদহ সাগরে প্রতিবছরের মার্চ মাসে হিন্দু ধর্মালম্বীদের রারুন্নী স্নান অনুষ্ঠিত হয়। স্নান শেষে পুণ্যার্থীগণ সাগরপাড়ে গঙ্গাপূজা ও সংকীর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।

শীলাদেবীর ঘাটঃ- গড়ের পূর্বপাশে রয়েছে করতোয়া নদী এর তীরে ‘শীলাদেবীর ঘাট’। শীলাদেবী ছিলেন পরশুরামের বোন। এখানে প্রতি বছর হিন্দুদের স্নান হয় এবং একদিনের একটি মেলা বসে।

জিয়ৎ কুন্ডঃ- এই ঘাটের পশ্চিমে জিয়ৎ কুণ্ড নামে একটি বড় কুপ রয়েছে, যা বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কথিত আছে এই কুপের পানি পান করে পরশুরামের আহত সৈন্যরা সুস্থ হয়ে যেত। যদিও এর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায়নি।

বেহুলার বাসর ঘরঃ- মহাস্থানগড় বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রায় ২কি.মি দক্ষিণ পশ্চিমে একটি বৌদ্ধ স্তম্ভ রয়েছে যা সম্রাট অশোক নির্মাণ করেছিলেন বলে মনে করা হয়। স্তম্ভের উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। স্তম্ভের পূর্বার্ধে রয়েছে ২৪ কোন বিশিষ্ট চৌবাচ্চা সদৃশ একটি গোসল খানা। এটি বেহুলার বাসর ঘর নামেই বেশি পরিচিত।

গোবিন্দ ভিটাঃ- মহাস্থানগড় জাদুঘরের ঠিক সামনেই গোবিন্দ ভিটা অবস্থিত। গোবিন্দ ভিটা শব্দের অর্থ গোবিন্দ (হিন্দু দেবতা) তথা বিষ্ণুর আবাস। এ ভিটা একটি খননকৃত প্রত্নস্থল, ১৯২৮-২৯ সালে খনন করে গোবিন্দ ভিটায় দূর্গ প্রাসাদ এলাকার বাইরে উত্তর দিকে অবস্থিত। কিন্তু বৈষ্ণব ধর্মের কোনো নিদর্শন এ স্থানে পাওয়া যায়নি। তবুও প্রত্নস্থলটি স্থানীয়ভাবে গোবিন্দ ভিটা নামে পরিচিত।

পরশুরামের প্রাসাদঃ- পরশুরামের প্রাসাদ ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়ের সীমানা প্রাচীর বেষ্টনীর ভিতরে যেসব প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম। স্থানীয়ভাবে এটি তথাকথিত হিন্দু নৃপতি পশুরামের প্যালেস নামে পরিচিত।

বৌদ্ধ বিহারসমূহঃ-

  1. সোমপুর বিহার
  2. হলুদ বিহার
  3. ভাসু বিহার
  4. আনন্দ বিহার
  5. সীতাকোট বিহার

কুষ্টিয়া হতে কিভাবে যাবেনঃ-

কুষ্টিয়া হতে বিআরটিসি এবং বিভিন্ন পরিবহন বগুড়া যায়। কুষ্টিয়া থেকে বগুড়ার দূরত্ব ২২৪ কিলোনিটার। মজমপুর এবং বাস টার্মিনাল হতে বাস পাবেন। বগুড়া শহর থেকে সিএনজি, টেম্পো, রিকশা করে মহাস্থানগড় যাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেনঃ-

বগুড়ায় থাকার জন্য রয়েছে বেশ কিছু হোটেল ও মোটেল। এগুলোর মধ্যে হোটেল নাজ গার্ডেন, পর্যটন মোটেল, সেফওয়ে মোটেল, নর্থওয়ে মোটেল, সেঞ্চুরি মোটেল, মোটেল ক্যাসল এমএইচ, হোটেল আকবরিয়া উল্লেখযোগ্য। আপনি এখানে চার তারকা হোটেলও পেয়ে যাবেন।

বগুড়ায় উন্নত মানের থাকার জায়গার মধ্যে আছেঃ-

  • হোটেল নাজ গার্ডেনঃ সিলিমপুর, বগুড়া-৫৮০০, ফোনঃ ৮৮-০৫১-৬২৪৬৮, ৬৬৬৫৫, ৬৩২৭২, ৬৪১৯৭, ৭৮০৮৮
  • পর্যটন মোটেলঃ বনানী মোড়, বগুড়া, ফোনঃ ০৫১-৬৬৭৫৩
  • আকবরিয়া হোটেলঃ কাজী নজরুল ইসলাম রোড, থানারোড, বগুড়া, ফোনঃ ০১৭১৬-১৭৯৯৮২
  • মোটেল নর্থ ওয়ে, শেরপুর রোড
  • হোটেল আল আমিন, নবাববাড়ি রোড
  • হোটেল রয়াল প্যালেস, উপশহর
  • হোটেল সান ভিউ,শেরপুর রোড
  • হোটেল সেফওয়ে, শান্তাহার মোড়
  • হোটেল রাজমনি, বগুড়া রাজা বাজার
  • হোটেল হানি ডে, বড় মসজিদ লেইন
  • হোটেল আজিজ, কবি নজরুল ইসলাম রোড
Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন