ইসলামের মূল পাঁচটি রুকনের মধ্যে তৃতীয় রুকন হলো রোজা। রোজা শব্দটি ফারসি যার আরবি প্রতিশব্দ হলো সাওম। সাওমের আভিধানিক অর্থ থেমে যাওয়া, বিরত থাকা বা বিরত রাখা। ইসলামি শরিয়তে সুবহে সাদিক থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়ত সহকারে কোনো কিছু পানাহার, পাপাচার ও কামাচার থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম বা রোজা। শুধু অনাহারে দিনযাপনের নাম সিয়াম নয়। শুধু উপবাসে স্বাস্থ্যগত কিছু উপকার হলেও হতে পারে, কিন্তু নৈতিক ও আত্মিক উন্নতির মুখ দেখা যেতে পারে না।
রোজা এবং তারাবির তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। দিনের বেলায় সিয়াম সাধনা আর রাতের বেলায় কিয়াম সাধনা মাহে রমজানের প্রধান বৈশিষ্ট্য। রোজা এবং তারাবিহ্ দ্বারা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিগত জীবনের যাবতীয় পাপাচার মোচন করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। যারা একমাত্র রাব্বুল আলামীনকে রাজি-খুশি করার নিমিত্তে রোজা এবং তারাবিহ্ আদায় করবে পাকপরওয়ার দিগারের রহমত ও মাগফিরাতের দুয়ার তাদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে। হজরত আবু হোরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলে করীম সাঃ রমজান শরীফে তারাবির প্রতি উৎসাহ প্রদান করতেন। তিনি এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি রমজান রজনীতে ঈমানসহ ও পুণ্যের আশায় তারাবির নামাজ আদায় করবে তার পূর্ববর্তী পাপগুলো ক্ষমা করে দেয়া হবে (মুসলিম শরিফ)।
নবী করীম সাঃ বলেন, হে লোক সকল! তোমাদের কাছে একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও বরকতপূর্ণ মাস আগমন করেছে। এ মাসে এমন একটি রাত রয়েছে, যা ১ হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম। গোটা রমজান মাসটিই আমাদের কাছে এক মহাপবিত্র এবং সওয়াব অর্জনের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। আর এ মাসের মধ্যে এমন একটি রাত রয়েছে যে রাতে ইবাদত-বন্দেগি করলে ১ হাজার মাসের ইবাদত-বন্দেগির চেয়েও অধিক ফজিলত হাসিল করা যায়। ওই রাতটি হলো ২৭ রমজানের রাত। এ রাতেই পবিত্র কুরআন মাজিদ নাজিল হয়েছিল বলেই রাতটি এত মর্যাদাপূর্ণ। আর কুরআন মাজিদ হলো মানবজাতির জন্য হিদায়াতের দিশারী।
বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার বান্দাদের মাহে রমজানের মাধ্যমে বিশেষ সুযোগ দান করেছেন নবী করীম সাঃ এরশাদ করেছেন রমজানের প্রথম অংশ হচ্ছে রহমত, মধ্যভাগ মাগফিরাত আর শেষ ভাগ হলো দোজখ থেকে মুক্তি।
হজরত আবু হোরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত, মহানবী সাঃ বলেছেন, প্রত্যেক জিনিসের জাকাত রয়েছে, আর শরীরের জাকাত হলো রোজা। (ইবনে মাজাহ) আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার আলোকে প্রমাণিত হয়, রোজা স্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণকর এবং জটিল রোগ থেকে মুক্তিদানকারী।
রোজাদাররা সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকেনঃ
- প্রথমত, যারা পাপ থেকে মুক্ত এবং অধীর আগ্রহে রমজানের জন্য অপেক্ষমাণ থাকেন। রমজান এদের জন্য অফুরন্ত রহমতের বার্তা নিয়ে উপনীত হয়।
- দ্বিতীয়ত, যারা পাপে লিপ্তঃ তবে রমজানের আগমন উপলক্ষে তওবা করতে থাকেন এবং পাপ থেকে দূরে থাকার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করতে থাকেন। রমজানের প্রথম দশক রোজা রাখার পর দ্বিতীয় দশক শুরু হওয়ার সাথে সাথে তাদের জন্য ক্ষমার ঘোষণা শোনানো হয়।
- তৃতীয়ত, ওই সব লোক যাদের পাপের বোঝা অত্যন্ত ভারী। কিন্তু রমজান আসার সাথে সাথে তারা তওবা করেন ও ভক্তিসহকারে রোজা রাখতে শুরু করেন। শেষ দশকে উপনীত হওয়ার পর এসব লোকের জন্যও জাহান্নাম থেকে মুক্তি নছিব হয়ে যায়।
সহীহ হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, হজরত আবু হোরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত প্রিয় নবী সাঃ বলেছেন, আল্লাহ বলেন, রোজা ছাড়া বনী আদমের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, রোজা আমার জন্য, আমি নিজেই তার প্রতিদান দেবো। (বুখারি শরিফ)।
রমজান মাস ও রোজার ফজিলত অপরিসীম। আবু হোরায়রা রাঃ বর্ণিত, বিশ্বনবী সাঃ বলেছেন যখন রমজান মাস শুরু হয়ে যায় তখন শয়তান ও অবাধ্য উচ্ছৃঙ্খল জিনদের বন্দী করা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় (রমজানের শেষ পর্যন্ত)। আর একজন ঘোষক এরূপ ঘোষণা দিতে থাকে হে কল্যাণ অন্বেষণকারী! অগ্রগামী হও। হে অকল্যাণের সন্ধানী! থেমে যাও। আর আল্লাহ জাহান্নাম থেকে পাপীদের দলে দলে মুক্তি দেন। আর এ ঘোষণা প্রতি রাতে দেয়া হয়ে থাকে। (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, আহমদ)।
হজরত সাহল ইবনে সাদ রাঃ থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবীজী সাঃ এরশাদ করেছেন, বেহেশতের আটটি দরজা রয়েছে। তন্মধ্যে একটি দরজার নাম 'রাইয়ান'। ওই দরজা দিয়ে শুধু রোজাদাররাই প্রবেশ করবেন। (বুখারি, মুসলিম শরিফ)।
হজরত আবু হোরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, হুজুর আকরাম সাঃ এরশাদ করেছেন, রোজাদারের জন্য দু'টি আনন্দ রয়েছে একটি হচ্ছে তার ইফতারের সময় এবং দ্বিতীয়টি তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের সময়। (বুখারি, মুসলিম) রোজাদার তার এই মহা আনন্দের প্রথমটি দুনিয়াতে লাভ করবেন আর দ্বিতীয়টি আখিরাতে লাভ করবেন।
হজরত আবু হোরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন প্রিয়নবী সাঃ এরশাদ করেছেন, যার হাতে আমি মুহাম্মদের প্রাণ তাঁর কসম, রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ তায়ালার কাছে মিশকের সুগন্ধের চেয়ে উৎকৃষ্ট। (বুখারি, মুসলিম)।
রমজান রহমত ও বরকতের মাস, গুনাহ মাফের মাস। জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাস। রিজিক বৃদ্ধির মাস। পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সাম্যের মাস। ৭০ গুণ সওয়াব বৃদ্ধির মাস। এ মাসেই জান্নাতের সব দরজা খুলে দেয়া হয়। জাহান্নামের সব দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। শবেকদরের মাস। এ রাতেই পবিত্র কুরআন শরিফ অবতীর্ণ হয়। বেশি বেশি নফল ইবাদত-বন্দেগির মাস। হাদিস শরিফে আছে, রমজানের নফল ইবাদতের সওয়াব ফরজের পরিমাণ দেয়া হয়, আর ফরজের সওয়াব বৃদ্ধি পেয়ে ১০ গুণ বেড়ে যায়। (মিশকাত)।
বিশ্বনবী সাঃ এরশাদ করেছেন, কেউ যখন রমজানের প্রথম রোজাটি করে ফেলে তখন আল্লাহ পাক তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে ৭০ বছরের দূরত্বে সরিয়ে দেন। (বুখারি শরিফ)।
নবী করীম সাঃ এরশাদ করেছেন, মানুষের আমলের সওয়াব ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, বান্দা একমাত্র আমার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই ইন্দ্রিয় তৃপ্তি এবং খাদ্য-পানীয় ত্যাগ করে।
হজরত আবু হোরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাঃ বলেছেন, কেউ যদি মিথ্যা কথা বলে, মিথ্যাচার পরিত্যাগ না করে, শুধু খাদ্য ও পানীয় পরিত্যাগ করায়, পরনিন্দা করে পরচর্চা করে, আল্লাহর সে রোজার কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারি শরিফ)। মহানবী সাঃ আরো বলেন, এমন অনেক রোজাদার আছে তাদের রোজা দ্বারা শুধু পিপাসাই লাভ হয়। (দারেমি)।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা যখন রোজা রাখবে, তখন অশ্লীল বাক্যালাপ করবে না। চেঁচামেচি করবে না। যদি কেউ গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে আসে বা তোমাকে গালি-গালাজ করে, তবে বলে দেবে, আমি রোজাদার। (ঝগড়া-ফ্যাসাদ আমার পক্ষে সাজে না) (বোখারি, মুসলিম)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাঃ বর্ণিত, প্রিয় নবীজী সাঃ এরশাদ করেছেন, যারা সেহরি খায় তাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত প্রেরণ করা হয়। ফেরেশতারাও তাদের জন্য রহমতের দোয়া করতে থাকেন। (তিবরানি)।
হজরত সহল রাঃ বর্ণিত, নবী করীম সাঃ এরশাদ করেছেন, লোকেরা তত দিন কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যত দিন তারা ওয়াক্ত হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করার বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করবে। (বুখারি, মুসলিম)।
হজরত সালমান ইবনে আমর রাঃ বর্ণিত, নবী করীম সাঃ এরশাদ করেছেন, তোমরা খেজুর দিয়ে রোজার ইফতার করবে। কেননা খেজুর অত্যন্ত বরকতময় ফল। যদি খেজুর না পাও তবে পানি দিয়ে ইফতার করো। কেননা পানি শরীরের ভেতর-বাহির পাক করে দেয়। (তিরমিজি)।
হজরত আবু হোরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলে পাক সাঃ বলেছেন, রোজাদার ব্যক্তিসহ তিন ব্যক্তির দোয়া কখনো ব্যর্থ হয় নাঃ
- ইফতারের সময় রোজাদার ব্যক্তির দোয়া
- ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ এবং
- অত্যাচারিত ব্যক্তি।
পবিত্র রমজানের রাত জেগে যে ব্যক্তি তারাবিহ ও তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে পারে, তার জীবনের সব গোনাহ্ মাফ হয়ে যায়। অনুরূপ পূর্ণ ঈমানসহ যে ব্যক্তি শবেকদরে নফল নামাজ পড়বে, তারও জীবনের সব গোনাহ্ মাফ করে দেয়া হবে। (বুখারি, মুসলিম)। পবিত্র রমজানের শেষের ১০ দিন অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেই ১০ দিনের মাঝেই রয়েছে লাইলাতুল কদর। (বুখারি শরিফ)।
লাইলাতুল কদরের এবাদত বান্দার যাবতীয় গুনাহ্গুলো ক্ষমা করে দেয়। (বুখারি শরিফ)।
নবী করীম সাঃ রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফের মাধ্যমে শবে কদর তালাশ করেছেন এবং করতে বলেছেন।
পবিত্র রমজান মাসে ফরজ জাকাত দেয়ার ফজিলত অনেক বেশি। এতিম, বিধবা, গরিব এবং বঞ্চিত অসহায়দের জন্য আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা হচ্ছে জাকাত। এটা সচ্ছল বিত্তবানদের ওপর দরিদ্র শ্রেণীর ন্যায্য হক; অনুগ্রহের দান নয়। রমজান মাসে যদি হকদারের সে হক পরিশোধ করে দেয়া হয় তবে এর দ্বারা যেমন দাতার সওয়াব সত্তর গুণ বেড়ে যায় তেমনি অসহায় হকদারদের রোজা রাখা ও ঈদের আনন্দ উপভোগের ক্ষেত্রেও বিশেষ সহায়তা হয়।