বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

বাঙালী নান্দনিকতায় রবীন্দ্রনাথ
বাঙালী নান্দনিকতায় রবীন্দ্রনাথ

নীহাররঞ্জন রায় "বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদি পর্ব" প্রবন্ধে বলেছেনঃ-

.. .. .. কাজেই, রাজা, রাষ্ট্র, রাজপাদোপজীবী, শিল্পি বণিক, ব্যবসায়ী, শ্রেষ্ঠী, মানপ, ভূমিবান মহত্তর, ভূমিহীন কৃষক, বুদ্ধিজীবি, সমাজসেবক, সমাজশ্রমিক, ‘অকীর্তিতান্ আচন্ডালান্ ’প্রভৃতি সকলকে লইয়া প্রাচীন বাংলার সমাজ। ইহাদের সকলকে লইয়া তবে বাঙালীর কথা, বাঙালীর ইাতিহাসের কথা।

তার মতে, ‘যদি বাঙালীর কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশের কথা বলি তবে, বাঙলার রাষ্ট্র ও রাজবংশাবলীর ইতিহাস যতটুকু আমরা জানি তাহার বেশিরভাগ উপাদান যোগাইয়াছেন লেখমালা। এই লেখমালা শিলালিপিই হোউক আর তাম্রলিপিই হোউক, ইহারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় রাজসভা কবি রচিত রাজা অথবা রাজবংশের প্রশান্তি, কোনও বিশেষ ঘটনা উপলক্ষে রচিত বিবরণ বা কোনও ভূমি দান-বিক্রয় দলিল, অথবা কোন মূর্তি বা মন্দিরে উৎকীর্ণ উৎসর্গলিপি।’ এই লেখা হতে জানা যায় বাঙালীর সাহিত্য চর্চ্চার অনুষঙ্গ এসেছিল রাজসভার সভাকবি, সভান্ডিত, সভাপুরোহিত, রাজগুরু কিংবা রাষ্ট্রের প্রধান কর্মচারীদের দিয়ে রচিত স্মৃতি, ব্যবহার ইত্যাদি জাতীয় গ্রন্থ তিব্বত ও নেপালে প্রাপ্ত নানা বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্ম ও সম্প্রদায়গত বিভিন্ন বিষয়ক পুঁথিপত্র হতেও অনেক উপাদান পাওয়া গেছে।

আমাদের বসবাসযোগ্য ভূমি, নিত্য দিনের আহার ও বসবাসের জন্য উৎপাদিত ফল ও ফসলের উৎপাদন, সময়, ঋতু, কেনা-বেচা,কর্ম-ধর্ম,ঘাট-অঘাটের হিসেব নিকেশে এক সময় সংস্কৃতিতে চৈত্র পেরিয়ে যুক্ত হয়েছিল বাংলা বর্ষ এবং তা থেকে এসেছিল বৈশাখ মাস। ঋতু রাজের নিয়মতান্ত্রিকতায় পুরাতনকে ঝড়িয়ে নতুনের কেতন উড়ায়ে বাংলা নববর্ষ আমাদেরকে স্বাগত জানিয়ে বৈশাখের অনুভবকে আপন করিয়ে নেয়। বৈশাখ মানেই আনন্দের মাত্লামি, আমরা এক কাতারে সবাই সমান। জোড়াসাঁকোর জমিদার পরিবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্ম নিলেন। তাঁর পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রিন্স ছিলেন।বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহর্ষি ছিলেন। বাবা খোদ কলকাতার মানুষ। কয়েক পুরুষের যে আঁচার, ওঠা, বসা তা বিলেতি মানুষের সাহচর্যের। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৬ কন্যা এবং নয় পুত্রের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ পুত্র বুধেন্দ্রনাথ ঠাকুর মাত্র এক বছরেই মারা যান। সে সূত্রে তার অগ্রজ বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই পরিবারের সর্ব কনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে জন্ম নিলেন। বাবা তার ছোট ছেলে রবীন্দ্রনাথের জন্ম হলে জন্মদিনে লিখে রাখলেন পঁচিশে বৈশাখ-১২৬৮ বঙ্গাব্দ। অর্থাৎ ঐ দিন ৭ মে-১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ হলেও তিনি তা লিখেন নাই।

বাঙালির সংস্কৃতিতে আরো একটি শুভ দিনের সূচনা হলো। আরো একটি ক্ষণের আগমনে উদিত হলো আরেকটি জ্যোতিষ্ক। স্বয়ং কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর আগে বাঙালির জীবনে চৈত্র্য সংক্রান্তি অথবা বর্ষবরণে সব বাঙালী এক কাতার বন্ধি হলেও সময়ের পালাবদলে আজ আমরা সব বাঙালী কবিগুরুর জন্ম জয়ন্তীতে আরো একবার সকলে আমরা সমান সম হয়ে পরি। বাংলা বর্ষবরণের গান, গীতিনাট্য, কবিতা, ঝড়া পাতার গান কিংবা আগমনি সুর বারতার রচনা বৈশাখ কে আলোকিত করলেও কবির মহা কালের গান, ‘ঐ মহা মানব আসে কিংবা আগুনের পড়শমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ এমন আরো গানে কবি আমাদেরকে জাগ্রত করে গেছেন মন-লোকের উত্তেজনা দিয়ে। বাংলা শব্দ, অর্থ, শাব্দিক মাত্রা, সুর এবং সংকটের উত্তরণ ঘটিয়ে তাকে উচ্চ মার্গে পৌছে দিয়ে গেছেন কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী সংস্কৃতির যে মাদকতা তা আসে লোক শিল্পের অনুসঙ্গ দিয়ে। কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, মহামতি লালন, মীর মশাররফ হোসেন, গগণ হরকরা, কবি জসীম উদ্দীন, এস এম সুলতান, কামরুল হাসান, শাহ আবদুল করীম, বিজয় সরকার, চৈতন্য মহাপ্রভূসহ হাজারো বাঙালী সৃষ্টি করে গেছেন। ধারণার এসব বিষয়কে আরো আরোপিত এবং রূপায়িত করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্র গবেষক আহসানুল কবির তাঁর ‘‘ রবীন্দ্রনাথের প্রথম আশ্রম শিলাইদহ’’ কাব্যে ‘বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গ শিলাইদহে রবীন্দ্র ইনস্টিটিউট’ নিবন্ধে জানাচ্ছেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু স্বদেশে এসেছেন। তাঁর সাথে এদেশের হিতৈষী এবং প্রখ্যাত সাহিত্যিক মৈত্রেয়ী দেবী সাক্ষাৎ করেন এবং কবির স্বাক্ষর করা একটি ফটোগ্রাফ জাতির জনককে উপহার দেন। বঙ্গবন্ধু ছবিটি মাথায় ঠেকিয়ে দেবীকে বললেন, দিদি আপনি কি জানেন স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর ছবি পাকহানাদারেরা যে বাড়ীতে কবির ছবি দেখেছে ঐ ছবিতে গুলি করেছে।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেনঃ-

‘আমরা বাঙালী হয়ে তার জন্য কিছুই করতে পারি নাই।’ তিনি বললেন, ‘আমার ইচ্ছে আছে তাঁর নামে একটা ইনস্টিটিউট করব।’

মৈত্রেয়ী দেবী বঙ্গবন্ধুর উদারতা দেখে এই ইনস্টিটিউটটি শিলাইদহে করতে বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন। আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান যুগে যুগে বাঙালীকে বিষম বিত্ত থেকে উত্তরণের জন্য লড়াই করে গেছেন। তাই জনক ভেবেছিলেন, শিলাইদহের অহংকারকে পুনরারোপোপিত করে তাকে সমৃদ্ধির শেখড়ে নিতে এখানে পশ্চিম বাংলার শান্তিনিকেতনের আদলে একটি ‘রেপ্লিকা’ গড়বেন। আমরা এখন যে স্বপ্নকে বাস্তব রূপ পরিগ্রহের এখনও স্বপ্ন দেখি। হয়তো শিলাইদহ হবে শান্তিনিকেতনের শান্তির আশ্রম বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ধরে।

এজমালি জমিদারির সময়ে জমিদারি তদারকির জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯০ সালের ২০ জানুয়ারী সিরাজগঞ্জ জেলার শাজাদপুর আসেন। তবে তারও আগে তিনি এসেছিলেন ১৮৮৮ সালে শিলাইদহে। তিনি শাজাদপুরে গিয়েছিলেন শিলাইদহ হতে। এখানে তিনি সাত বছর জমিদারি তদারকি করেছিলেন। তবে কবি সাহিত্য সৃষ্টির কোনো উপাদান নিতে কোনো কার্পণ্য করেন নাই। এখানকার নৈসর্গিক প্রিয়তাকে অনুধাবন করেছেন কবি নির্বিৃষ্ট চিত্তের অন্তরকোণ থেকে। এখানে বসে কবির চিঠি লেখা, কাব্য রচনা করা, কবিতা লেখা,ছড়া, নাটক লেখা সম্ভব হয়েছিল। প্রকৃতির সুন্দর রূপকে প্রেয়সি করতে শিলাইদহ এবং শাজাদপুর অভিন্ন মননের।

শাজাদপুরে বসে তিনি ইন্দিরা দেবীকে লিখলেনঃ-

‘‘ ... .. আমাদের দেশে প্রকৃতিটা সবচেয়ে বেশী চোখে পড়ে- আকাশ মেঘমুক্ত, মাঠের সীমা নেই, রৌদ্র ঝাঁ ঝাঁ করছে, এর মধ্যে মানুষকে অতি সামান্য মনে হয়- মানুষ আসছে এবং যাচ্ছে এই খেয়া নৌকার মত পারাপার হচ্ছে- তাদের অল্প অল্প কলরব শোনা যায়,.. .. ।’’

কবি রবীন্দ্রনাথ, শিলাইদহ-শাজাদপুর, খেয়া নৌকা-যাত্রী, রূপ-প্রকৃতি, কিংবা গীতাঞ্জলির জারক রসই কিন্তু এক সূত্রে গাঁথা। এখন নদী আছে, আছে জল। তবে শিলাইদহ এবং শাজাদপুরের যোগ সূত্রকে আরো আবদ্ধ করতে প্রয়োজন ‘রবীন্দ্রনাথ কিংবা গীতাঞ্জলি সেতু।’ যা রবীন্দ্র প্রেমিদের অন্তরাত্মাকে আরো উচ্ছ্বাসিত করতে সহায়ক হবে।

পঁচিশ বৈশাখ আসে। আবার তা চলেও যায়। আমাদের বাঙালী হৃদয়ের অন্যতম হৃদম। রবীন্দ্রনাথ পাকিস্তানে যতটা না উপেক্ষার ছিল, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও কবি রবীন্দনাথ হতে পারেননি তত উচ্চতার। আমাদের শরীর শিরার অস্থিমজ্জায় বাঙালীর যে স্মারকধারা তা এখনও উৎসারিত হয় শিলাইদহ এবং এখানে সৃষ্ট রবীন্দ্রনাথের মহিমা থেকে। সে জন্য প্রার্থণা বৈশাখে ঝড়া পাতা ঝড়ে যাক। নতুন পাতার মৌলিকতায় ভ্রমর গুঞ্জনে সুরের মূর্চ্ছনা নিয়ে পঁচিশে বৈশাখে শিলাইদহের আঙিনায় বারবার ফিরে আসুক রবীন্দ্রনাথ। কবির সপ্রতিভ সরলভাব এবং তার সৃষ্টিকর্মে আমরা সকলে পুণ্যাহ ভালবাসায় মেতে উঠি বারংবার।

লেখক: গবেষক, উদ্ভাবক ও পরিবেশ ব্যক্তিত্ব।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.