সাময়িকপত্র-সম্পাদনা, প্রকাশনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানের আদিপর্বের উদ্যোগ ও অবদান সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে ওই সমাজের আধুনিক যুগের সাহিত্যচর্চার সূচনার ইতিহাসটিও স্মরণে রাখতে হয়। সাহিত্যের মতো সাময়িকপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রেও বাঙালি মুসলমানের বিলম্বিত আত্মপ্রকাশ ঘটে। তার কারণও ওই একই সূত্রে গাঁথা।
বিষাদ-সিন্ধু কিংবা জমীদার দর্পণের মতো ধ্রুপদী-সাহিত্যের স্রষ্টা মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১) উনিশ শতকের এক গুরুত্বপূর্ণ লেখক। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিম-প্রয়াসের সার্থক সূচনা তাঁকে দিয়েই। সব্যসাচী শিল্পীব্যক্তিত্ব মশাররফ ছিলেন নব্য-উত্থিত মুসলিম মধ্যশ্রেণির প্রধান সাংস্কৃতিক মুখপাত্র। মুক্ত মন, উদার শিল্পদৃষ্টি, সমাজমনস্কতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা তাঁর জীবন ও সাহিত্যচর্চায় যেমন, সাময়িকপত্র-পরিচালনার ক্ষেত্রেও তেমনই প্রতিফলিত হয়েছে। মশাররফের সাহিত্যজীবনের সঙ্গে তাঁর সাংবাদিকতা-কর্ম ও সাময়িকপত্র-সম্পাদনার যোগসূত্র অত্যন্ত গভীর। সাহিত্যের মতো সাময়িকপত্র-প্রকাশনার মুসলিম-উদ্যোগের ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা পথিকৃতের।
সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতা – এই দুই পর্যায়েই মীর মশাররফ হোসেন প্রত্যক্ষ প্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন মূলত গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা-সম্পাদক কুমারখালীর কাঙাল হরিনাথ মজুমদার এবং সেইসঙ্গে কলকাতার সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। এই দুই প্রাজ্ঞ সাময়িকপত্র-পরিচালকের উৎসাহ ও তত্ত্বাবধানেই মশাররফের সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। মশাররফ তাঁর আত্মকথা আমার জীবনীতে (১৯০৮-১০) স্মরণ করেছেন :
কলিকাতার সংবাদ প্রভাকর সম্পাদক শ্রীযুক্ত বাবু রামপ্রাণ গুপ্ত। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। সহকারী সম্পাদক ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সহিত পত্রে পত্রে দেখাশুনা যেরূপ হইতে পারে তাহা আছে। আমি অনেক সংবাদ তাঁহাদের কাগজে লিখিতাম। তাঁহারাও দয়া করে ছাপাইতেন। আমাকে নির্দ্দিষ্ট করিয়াছিলেন – ‘‘আমাদের কুষ্টিয়ার সংবাদদাতা’’।… সাদাসিদে ভাবে সংবাদ লিখিতাম। ভুবনবাবু কাটিয়া ছাঁটিয়া প্রকাশের উপযুক্ত করিয়া দিতেন।… কুমারখালীতে সে সময়ে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা প্রকাশ হইত। কুমারখালী, আমার বাড়ী হইতে নিকটে। গ্রামবার্ত্তা সম্পাদক বাবু হরিনাথ মজুমদার মহাশয় আমাকে কনিষ্ঠ ভ্রাতার ন্যায় স্নেহ করিতেন। আমিও তাঁহাকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ন্যায় মান্য করিতাম, সপ্তাহে সপ্তাহে গ্রামবার্ত্তায় সংবাদ লিখিতাম, প্রভাকরেও লিখিতাম।… এদিকে হরিনাথবাবু আর কলিকাতার দিকে ভুবনবাবু আমার সামান্য লিখা সংশোধন করিয়া প্রভাকরে প্রকাশ করা আরম্ভ করিলেন।
– এই বিবরণ ১৮৬৫ সালের। এইভাবে তিনি সাংবাদিকতা ও সংবাদ-সাময়িকপত্র সম্পর্কে আগ্রহী ও অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন। উত্তরকালে পত্রিকা-সম্পাদনায় তাঁর এই শিক্ষানবিশির অভিজ্ঞতা বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। এর নয় ও পঁচিশ বছর পরে তাঁর সম্পাদনায় দুটি পত্রিকা প্রকাশিত হয় : আজীজন নেহার (১৮৭৪) ও হিতকরী (১৮৯০)। এছাড়া তিনি কোহিনুরসহ আরো কয়েকটি পত্রিকার সঙ্গেও পরিচালক-সমিতির সদস্য, উপদেশক বা লেখক হিসেবে যুক্ত ছিলেন।
সাময়িকপত্র-প্রকাশনার ক্ষেত্রে আজীজন নেহার মশাররফ হোসেনের প্রথম প্রয়াস। আজীজন নেহার পত্রিকা প্রকাশের প্রেরণা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে মশাররফ তাঁর অপ্রকাশিত আত্মজীবনীতে জানাচ্ছেন :
আমার ভ্রাতাগণ হুগলী কলেজে পড়িতেছে। চুঁচুড়ায় আমাদের একটি বাসাবাড়ী আছে। সময় সময় চুঁচুড়ায় যাওয়া আসা করি। একদিন চুঁচুড়ায় বান্ধা ঘাটে বসিয়া গঙ্গার জলস্রোতে [নানা] বিষয় ভাবিতেছি।… অপর পারে বাঙ্গলার সুপ্রসিদ্ধ লিখক বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ী। একদিন সন্ধ্যার কিছু পূবের্ব বঙ্কিমবাবুকে সামান্য একখানি নৌকার উপর বান্ধাঘাট হইতে পূবর্ব পার যাইতে দেখিলাম। সঙ্গে একজন আরদালী। হুগলীর ফৌজদারী কাচারী হইতে বাড়ী যাইতেছেন। প্রত্যহ এইরূপ যাওয়া [আসা] করেন। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন মুসলমান ছাত্র ছিলেন। আমাদের সমাজে বাঙ্গলাভাষার চ্চর্চা একেবারে নাই বলিয়া অনেক দুঃখ করিলেন আর বলিলেন আমাদের সমাজে একখানি বাঙ্গালা খবরের কাগজ নাই বড়ই আক্ষেপের বিষয়।
এই চিন্তার ফলশ্রুতিতে আজীজন নেহার ‘মাসিক’পত্রটি হুগলি কলেজের কতিপয় উৎসাহী মুসলমান শিক্ষার্থীর উদ্যোগে ও মশাররফ হোসেনের সম্পাদনায় চুঁচুড়া থেকে প্রকাশিত হয়। এর প্রস্ত্ততি-প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় (১৬ চৈত্র ১২৮০) আজীজন্ নেহার শিরোনামে ‘হুগলী কলেজে’র ‘কএকজন মুসলমানে’র বরাতে এই পত্রিকার প্রকাশ-বিষয়ে একটি ‘বিজ্ঞাপন’ প্রচারিত হয়। তাতে এই মাসিকপত্রটি ‘আগামী বৈশাখ হইতে’ প্রকাশের ঘোষণার পাশাপাশি কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়ার ঠিকানায় মীর মশাররফকে চিঠি লিখলে পত্রিকা পাওয়া যাবে বলে জানানো হয়।
মীরের প্রথমা পত্নী আজীজননেসার নামে এই পত্রিকার নামকরণ। সমকালীন পত্র-পত্রিকায় আজীজন নেহারের আলোচনা প্রসঙ্গে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায়। পত্রিকাটি দুষ্প্রাপ্য বলে পত্র-পত্রিকার বিজ্ঞাপন-সংবাদ-সমালোচনা বা নিবন্ধের মন্তব্য এবং মশাররফের ভাষ্যই এ-বিষয়ে ধারণা গ্রহণের মূল উৎস। কেননা এ-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ-সম্পাদকীয়-প্রবন্ধ-নিবন্ধের নমুনা আজ আর সুলভ নয়।
কাঙাল হরিনাথের গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় (আষাঢ় ১২৮১) আজীজন নেহার সম্পর্কে এই আলোচনাটি প্রকাশ পায় :
‘আজীজন নেহার’ মুসলমান কর্ত্তৃক সম্পাদিত পাক্ষিক পত্রিকা। আমরা ক্রমান্বয়ে ইহার ৩ সংখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছি। ইহার লেখকগণ আমাদিগের পরিচিত, এই ইঁহাদের নব্যোদ্যম নহে, তবে সাহস করিয়া পত্রিকা প্রচার করা নূতন বটে। ইঁহারা যে গুরুতর উদ্দেশ্যে লেখনী ধারণ করিয়াছেন, তাহা সংসিদ্ধ হইবার যদিও অন্তরায় লক্ষিত হয়, তথাপি আজীজন নেহার দ্বারা তাহার কিছু না কিছু নিরাকৃত হইবে এরূপ আশা বিড়ম্বনার বিষয় নহে। ইহাতে যে কয়েকটী প্রস্তাব প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষে অতি উপাদেয় ফল বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে। আমরা প্রস্তাবগুলি মনোযোগসহ পাঠ করিয়া পরম সন্তুষ্ট হইয়াছি। ভাষা অতি মনোরম। মুসলমান লিখিত বলিয়া মনে হয় না, এমন কি অনেক আধুনিক হিন্দু লেখকের লিপি-চাতুর্য্যকে ইহার নিকট বলিদান দিতে পরামর্শ দি।…
এডুকেশন গেজেটে (১ মে ১৮৭৪/ ১৯ বৈশাখ ১২৮১) প্রকাশিত ‘শ্রীপূ-’ ছদ্মনামে জনৈক পাঠকের এক চিঠিতে এই ‘মাসিক সংবাদপত্রে’র প্রশংসা করে মন্তব্য করা হয় : ‘দেখুন… মহম্মদীয়গণ মধুময় বাঙ্গালা ভাষার যথার্থ স্বাদগ্রহণে কেমন সমর্থ হইয়াছেন।’ পরের সপ্তাহে আজীজন নেহার পত্রিকার আলোচনা-প্রসঙ্গে এডুকেশন গেজেটে (৮ মে ১৮৭৪) আরো খোলাসা করে বলা হয় :
আমরা সম্প্রতি দুইখানি নূতন সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রাপ্ত হইয়াছি। একখানির নাম ন্যাসনেল বজেট,… অপরখানির নাম আজীজন্ নেহার। হুগলী কলেজের কতিপয় মুসলমান যুবক ইহার প্রচার আরম্ভ করিয়াছেন। ইহার মূল্যের ও প্রচারের সময়েরও এখন নিরূপণ হয় নাই। প্রচারকগণ লিখিয়াছেন, ‘‘এবারে মূল্যের কিছুই নির্ণয় করা গেল না। পাঠকগণের উৎসাহসূচক পত্রিকা ও গ্রাহকগণের সংখ্যাবৃদ্ধি দেখিলেই আগামী মাস হইতে পাক্ষিকরূপে প্রকাশের ইচ্ছা রহিল।’’ এই পত্রিকাখানির বিষয়ে বিশেষ বক্তব্য এই, এখানি মুসলমানের লিখিত, অথচ ইহাতে মুসলমানি বাঙ্গালার নামগন্ধ নাই, বিশুদ্ধ বাঙ্গালার রীতিতে লিখিত। লেখকেরা উৎসাহ পাইবার যোগ্য, তাহার সন্দেহ নাই। আমরা উভয় পত্রিকারই মঙ্গল কামনা করি।
সেকালের আর-এক বিশিষ্ট পত্রিকা সোমপ্রকাশ (১৮ মে ১৮৭৪) খুবই সংক্ষিপ্ত কথায় এই আজীজন নেহারের আবির্ভাবকে স্বাগত জানিয়েছিল :
আজিজন নেহার। এখানি নূতন সংবাদপত্র। ইহার বিশেষ চিহ্ন এই কতিপয় মুসলমান দ্বারা সম্পাদিত হয়। কাগজখানি পড়িয়া আমরা আনন্দিত হইয়াছি। ইহার ভাষা অনেক বিজ্ঞ বিজ্ঞ সম্পাদকের ভাষার অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট। আমরা সবর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা করি যে কাগজখানি দিন দিন উন্নত হউক।
চুঁচুড়ার সাধারণী সাপ্তাহিকে (২৫ জ্যৈষ্ঠ ১২৮১) ‘নূতন পত্রিকা’ শিরোনামে আজীজন নেহারের প্রকাশকে অভিনন্দন জানিয়ে মন্তব্য করা হয় :
আজিজন নেহার, বঙ্গীয় মুসলমানগণের মুখস্বরূপ হইয়া প্রকাশিত হইতেছে; বড় আহ্লাদের বিষয়। সকল সম্প্রদায়েরই পৃথক পৃথক পত্রিকা থাকা উচিত। বিশেষত বঙ্গে মুসলমানের সংখ্যা বড় অল্প নহে। নিজ বাঙ্গালায় হিন্দু ১,৮১,০০,৪৩৮ জন, মুসলমান ১,৭৬,০৯,১৩৫ জন, সুতরাং নিজ বাঙ্গালায় হিন্দুমুসলমান প্রায় সমানই। অথচ মুসলমানদের হইয়া প্রায় কেহই কোন কথা কহেন না, এটি ক্ষোভের বিষয় বলিতে হইবে। এতদিন পরে মুসলমানেরা আপনাদের জিহবা সঞ্চালন করিবেন। একটি কথা, আজিজন নেহারে দুইজন বাঙ্গালী হিন্দু লেখকও এজেন্ট বলিয়া পরিচিত হইয়াছেন, আমাদের বিবেচনায় এরূপ না হইলেই ভাল হইত। ভরসা করি প্রকাশকগণ এ বিষয়ে একটু বিবেচনা করিয়া দেখিবেন। যাহা হউক আজিজন নেহার চিরস্থায়ী হয় ইহা আমাদের একান্ত ইচ্ছা। হুগলি কালেজের মুসলমান ছাত্রগণ ইহা প্রকাশ করিতেছেন, আজিজন নেহার আমাদের একরূপ প্রতিবাসী। এরূপ উদারচেতা প্রতিবাসীর মঙ্গল হউক।
কিন্তু এই শুভেচ্ছা-জ্ঞাপনের কিছু পরেই সাধারণী (২৯ আষাঢ় ১২৮১) আজীজন নেহার পত্রিকার বিরুদ্ধে রুচিবিকারের অভিযোগ উত্থাপন করে একটি ব্যঙ্গাত্মক বিরূপ সমালোচনা প্রকাশ করে :
আজিজন নেহার। এই অভিনব পত্রের আমরা যথার্থই শুভানুধ্যায়ী। নহিলে সম্বাদপত্রের দ্বিতীয়বার সমালোচন সাধারণীতে সম্ভবে না। আজিজন নেহার ক্রমে একটি পক্ষীর দল হইয়া উঠিতেছে। পত্র এই চারি সংখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে, ইতিমধ্যে ইহাতে কাকাতুয়া, বুলবুলি, টুনটুনি, দাঁড়কাক, ফিঙ্গে ও তোতা দেখা দিয়াছে; শুদ্ধ চিড়িয়াখানা প্রদর্লন [প্রদর্শন] করিয়াই আজিজন ক্ষান্ত নহেন, লক্ষ্ণৌয়ের নবাব কৃত্রিম পাহাড়ে যোড়া [বোড়া] সাপ দেখান; ইঁহারা ইতিমধ্যে কেঁচো লাহির [বাহির] করিয়াছেন, বোধহয় ক্রমে সাপ বাহির করিবেন।
বিদ্রূপ ত্যাগ করিয়া আমরা জিজ্ঞাসা করি, অভিনব পত্র সম্পাদকের এরূপ রুচি কেন? এ রুচি বিকৃতা।
সাধারণীর এই ক্ষোভের প্রকৃত কারণ আমাদের কাছে অস্পষ্টই রয়ে গেলো।
এ-পর্যন্ত মূলত এডুকেশন গেজেট, সোমপ্রকাশ, সাধারণী ও গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকাই ছিল আজীজন নেহার পত্রিকা সম্পর্কে ধারণার মূল উৎস। তবে বেশ কিছুকাল আগে আবিষ্কৃত মশাররফ হোসেনের অপ্রকাশিত আত্মজীবনী, স্বরচিত জীবনবৃত্তান্ত ও দিনপঞ্জিতে আজীজন নেহার সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কিছু তথ্য মেলে। এর ভিত্তিতে এই পত্রিকার নামকরণ, প্রকাশের উদ্দেশ্য, প্রকাশকাল, প্রকাশ-ব্যবধান, স্থায়িত্ব, প্রকাশ-বন্ধের কারণ – এসব বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা অর্জন করা যায়। ফলে আজীজন নেহার পত্রিকা সম্পর্কে পূর্বসূরিদের অনেক অভিমত-অনুমান-সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা ও সংশোধনের সুযোগ মিলেছে।
পত্নী আজীজননেসার প্রতি মশাররফের বিরূপ ধারণা ও অপ্রসন্ন মনোভাব কখনো প্রচ্ছন্ন ছিল না। এই প্রথমা পত্নী যে তাঁর জীবন কলহ-বিবাদে অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন, সেই ঘরোয়া কথা জানাতেও তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। দাম্পত্যজীবন অসহ হয়ে ওঠায় তিনি দ্বিতীয় বিয়ের প্রেরণাও পান। দীর্ঘ বত্রিশ বছর সংসার করার পর মশাররফ প্রথম পক্ষকে শেষ পর্যন্ত তালাকও দিয়েছিলেন। তবুও এই ‘হাড়জ্বালানী’ পত্নীর নামেই পত্রিকার নামকরণের বিষয়টি রহস্যজনক ও বিস্ময়কর। তাঁর অপ্রকাশিত আত্মজীবনী থেকে জানা যায় (এই বিবরণ শামসুজ্জামান খানের প্রবন্ধ থেকে গৃহীত : সচিত্র-সন্ধানী, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯) : ‘প্রথম স্ত্রী আজিজননেসা।… এই স্ত্রীর নামেই ‘আজিজননাহার’ পত্রিকা প্রকাশ করা।’ নামকরণের তাৎপর্য সম্পর্কে আভাস দিয়ে মশাররফ বলেছেন :
পত্রিকার নাম আজিজননাহার হইবার কারণ কি? আজ পর্য্যন্ত নামকরণ কেহই জ্ঞাত নহেন। এখন সময় হইয়াছে বলিয়া প্রকাশ করিলাম। ‘আজিজননাহার’ – ‘প্রিয়দিন’ এই অর্থের ভাব লইয়া পত্রিকার শিরোদেশে লিখিত ছিল :
দীনপ্রিয় হের সদা সদয় নয়নে।’
আজীজন নেহার পত্রিকার প্রকাশ-ব্যবধান নিয়ে মতভেদ আছে। অবশ্য এই বিভ্রান্তির জন্যে মীরের বক্তব্যও অনেকাংশে দায়ী। তিনি কখনো এই পত্রিকাকে ‘পাক্ষিক’, কখনো বা ‘মাসিক’ বলে চিহ্নিত করেছেন। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় একে ‘মাসিক’ বলে উল্লেখ করলেও আবদুল গফুর সিদ্দিকী ‘সাপ্তাহিক’ ও আলী আহমদ গ্রামবার্ত্তাকে অনুসরণ করে ‘পাক্ষিক’ বলে অভিহিত করেছেন। অবশ্য গ্রামবার্ত্তায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে পত্রিকাটি ‘মাসিক’ হিসেবে প্রকাশ পাবে বলে উল্লেখ করা হয়। এডুকেশন গেজেটে প্রথমে ‘মাসিক’, আবার এক সপ্তাহ পরে ‘সাপ্তাহিক’ হিসেবে আজীজন নেহার পরিচিতি পায়।
আজীজন নেহার পত্রিকা প্রকাশের ফলে বাঙালি সমাজে, বিশেষ করে মুসলমান সমাজে, বিশেষ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এ-সম্পর্কে মশাররফ তাঁর অপ্রকাশিত আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন :
মাতামহীর স্বর্গারোহণের পর ১২৮১ সালের ১লা বৈশাখ ‘আজিজন নেহার’ নামে বাঙ্গলা মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করিলাম। মুসলমান সমাজে এই বাঙ্গালা পত্রিকা বঙ্গদেশে প্রথম প্রকাশিত হইল। বাঙ্গালী মুসলমানসমাজ জানিত না বুঝিত না যে সংবাদপত্র কি? প্রথম খন্ড প্রকাশ হইলে মহা আন্দোলন উপস্থিত হইল। ঘরের পয়সা খরচ করিয়া পরের ঘরে এরূপ খবরের কাগজ পাঠাইলে লাভ কি? সকল কথাই কি সত্য লিখা হয়? এত খবর পায় কোথা? যাহা হউক যিনি যাহা বলিতে লাগিলেন কান পাতিয়া শুনিতে লাগিলাম। মনকে দৃঢ় করিলাম। বিচলিত হইব না। যাহা সংকল্প তাহাই স্থির। প্রথম খন্ডে ‘‘সূচনা’’ ‘‘কি লিখি’’ এই দুই প্রবন্ধ প্রকাশ হইল।
মশাররফ যখন হুগলিতে ছিলেন, সেইসময়েই আজীজন নেহার পত্রিকা চুঁচুড়া থেকে প্রকাশিত হয়। কিন্তু মশাররফের অপ্রকাশিত আত্মজীবনী থেকে জানা যায় লাহিনীপাড়া থেকেই তিনি পত্রিকা পরিচালনা করতেন : ‘দুই বৎসরের মধ্যে কলিকাতা কি কৃষ্ণনগর যাই নাই। বাড়িতে বসিয়াই ‘আজিজন নাহার’ পত্রিকা পরিচালনা কার্য্যে নিযুক্ত রহিয়াছি।’
পত্রিকা মোটামুটি দুবছর চলেছিল বলে খবর পাওয়া যায়। অনুমান করা চলে, পত্রিকাটি চুঁচুড়া থেকে প্রকাশের প্রথম পর্যায়ে মশাররফ সেখানে ছিলেন, তারপর লাহিনীপাড়ায় ফিরে আসেন এবং এখান থেকেই পত্রিকা-সংক্রান্ত কাজকর্ম সম্পাদন করতেন। হয়তো ক্বচিৎ কখনো চুঁচুড়ায় যেতে হতো তাঁকে।
মূলত সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই এই পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। সেইসঙ্গে পত্রিকার পরিচালকদের উদাসীনতা ও অন্তর্দ্বন্দ্বও কম দায়ী ছিল না, সাধারণীর (২ আগস্ট ১৮৭৪) সূত্রে সে-কথা জানা যায়। মশাররফ তাঁর অপ্রকাশিত আত্মজীবনীতেও এসব কথা কিছু কিছু লিখে গেছেন :
আজিজননাহার পত্রিকায় প্রথম দুই বৎসর বেশ টাকা আদায় হইল। তাহার পর আমারও মন খারাপ। লিখাও আর পূবের্বর মত উৎসাহের সহিত হইল না। মূল্যও পাওয়া যায় না… প্রেসের দেনা, কাগজের দেনা অনেক দায়ী হইতে হইল। পৃষ্ঠপোষক কাহাকেও পাইলাম না। লিখিবার লোকও আর নাই। মধ্যে মধ্যে আমার ভক্তিভাজন হরিনাথ মজুমদার বিশেষ সাহায্য করিতেন। আমার দুঃসময় সমাগত বলিয়াই যেন তাঁহার মাথার বেদনা। শীরপীড়া রোগ উপস্থিত হইল। তিনি লিখাপড়ার কর্ম্ম হইতে এক প্রকার বিরত হইলেন।
এরপরেও পত্রিকা প্রকাশের চেষ্টা করেন তিনি, কিন্তু অর্থাভাবে তা ব্যর্থ হয়। বলেছেন তিনি :
‘পত্রিকা বন্ধ হইয়াছে। যে প্রেসে ছাপাইতাম তাহাদের অনেক টাকা বাকি পড়ায় – হুগলী বোধোদয় যন্ত্রে ছাপাইতে দিলাম। টাকা অভাবে ছাপান কাগজগুলি সেই প্রেসেই রহিয়া গেল।’
আজীজন নেহার পত্রিকা কতদিন চলেছিল সে-সম্পর্কে হিতকরী পত্রিকায় প্রকাশিত (১০ বৈশাখ ১২৯৮) ‘হিতকরীর আত্মকথা’ নিবন্ধ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় : ‘কুষ্টিয়া সবডিভিসন সৃষ্ট হইতে এ পর্য্যন্ত এই হিতকরী লইয়া তিনখানি পত্রিকা প্রকাশ হইল। প্রথম গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা, তাহার পর আজীজননাহার। আজীজননাহার দুই বৎসরকাল চলিয়াছিল…।’
আনিসুজ্জামানের তালিকা-অনুসারে মশাররফের আজীজন নেহারের আগে মুসলিম-পরিচালিত তিনটি পত্রিকার খবর মেলে : সমাচার সভারাজেন্দ্র (সাপ্তাহিক, ১৮৩১), জগদ্দুদ্দীপক ভাস্কর (সাপ্তাহিক, ১৮৪৬) ও ফরিদপুর দর্পণ (পাক্ষিক, ১৮৬১)।
ফারসি-বাংলা দ্বিভাষিক সমাচার সভারাজেন্দ্র পত্রিকার স্বত্বাধিকারী-মুদ্রাকর-প্রকাশক শেখ আলীমুল্লাহ ছিলেন বলে কেউ কেউ মনে করলেও এর সম্পাদক হিসেবে সরকারি দপ্তরে নাম পাওয়া যায় দুর্লভচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। জগদ্দুদ্দীপক ভাস্কর ছিল ‘খুবই স্বল্পায়ু’ পত্রিকা। প্রকাশের জন্যে বিজ্ঞাপিত হলেও ফরিদপুর দর্পণ আদৌ বেরিয়েছিল কী না সে-সম্পর্কে সংশয় আছে (মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র, ঢাকা, ১৩৭৬)।
প্রকাশকালের ক্রমানুসারে নয়, পরিচিতি ও পাঠকপ্রিয়তার বিষয় বিবেচনায় এনেই হয়তো সাধারণভাবে আজীজন নেহারকেই মুসলিম বাংলা সাময়িকপত্র-সাধনায় প্রথম সার্থক প্রয়াস হিসেবে উল্লেখ করা হয়। হিতকরী পত্রিকায় (৩০ আশ্বিন ১২৯৮) বলা হয়, ‘…মুসলমান লিখিত বাঙ্গালা সংবাদ পত্রিকা’র মধ্যে আজীজন নাহার পত্রিকাই প্রথম প্রকাশিত হয়। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ও (১৮৬১-১৯৩০) মন্তব্য করেছেন, আজীজন নেহারই ‘মুসলমান সম্পাদিত পত্রিকার মধ্যে… সবর্বপ্রথম বলিয়া পরিচিত’ (প্রদীপ, পৌষ ১৩০৮)।
স্বল্পজীবী হলেও আজীজন নেহার সমকালে সমাদৃত হয়েছিল। সমাজহিতৈষণার আদর্শ নিয়ে এই পত্রিকার আত্মপ্রকাশ। সমাজ-সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতাবোধ জাগিয়ে তা মোচনের উদ্দেশ্য যে এই পত্রিকার ছিল তা গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার (জুন ১৮৭৪) আলোচনা-সূত্রে জানা যায়। আজীজন নেহার সম্পাদনার অভিজ্ঞতা উত্তরকালে মশাররফের সাময়িকপত্র-পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ কাজে লেগেছিল।
হিতকরী মীর মশাররফ হোসেন-সম্পাদিত দ্বিতীয় পত্রিকা। আজীজন নেহার প্রকাশের পর ষোলো বছর বিরতি দিয়ে আবার নতুন পত্রিকা বের করার উদ্যোগ নেন মশাররফ। হিতকরীর উদ্বোধনী সংখ্যায় (১ম ভাগ ১ম সংখ্যা : ১৫ বৈশাখ ১২৯৭) পত্রিকার প্রকাশনা-বিষয়ে নানা তথ্য পাওয়া যায়। এই সূত্রে হিতকরীর প্রকাশকাল সম্পর্কে সঠিক ও সুস্পষ্ট ধারণালাভের সুযোগও মিলেছে। বলা হয়েছে : ‘হে! অনন্তশক্তি সম্পন্ন করুণাময়, কৃপাময়, কৃপাসিন্ধু ভববন্ধু ভগবান! তোমারই অনন্তগুণ আশ্রয় ও সহায় করিয়া হিতকরী ১২৯৭ সনের ১৫ই বৈশাখে প্রকাশ হইল।’
হিতকরী – এই পত্রিকা তার নামের সার্থকতা প্রমাণ করেছিল জনকল্যাণের আদর্শ অনুসরণ করে। পত্রিকার উদ্দেশ্য ও নীতি সম্পর্কে স্পষ্টই জানানো হয় :
সকলের হিতকথা, যাহাতে সবর্বসাধারণের হিতের আশা থাকে, সেই সকল কথাই হিতকরীতে প্রকাশ হয়। জাতিগত, কি ধর্ম্মগত কোন পক্ষকে লক্ষ্য করিয়া কিছু প্রকাশ হয় না। (হিতকরী, ওই) এই বক্তব্য থেকে হিতকরীর উদার মত, সর্বজনীন মনোভাব ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়।
হিতকরী কুমারখালী মথুরানাথ যন্ত্রে মুদ্রিত এবং কুষ্টিয়া লাহিনীপাড়া থেকে প্রকাশিত হতো। পত্রিকার মুদ্রাকর ও প্রকাশক ছিলেন যথাক্রমে রজনীকান্ত ঘোষ ও দেবনাথ বিশ্বাস। প্রতি সংখ্যার মূল্য ছিল দুই পাই আর ডাকমাশুলসহ বার্ষিক মূল্য দুই টাকা। সম্পাদক হিসেবে কারো নাম ছাপা হতো না। তবে মীরের অপ্রকাশিত স্বরচিত জীবনবৃত্তান্ত থেকে জানা যায় যে, তিনি ‘১২৯৭ সালে ১৫ই বৈশাখ হিতকরী নামক পত্রিকার সম্পাদক হয়েন।’ অন্যান্য তথ্য ও পত্রিকার অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য-সাবুদও এই বক্তব্য সমর্থন করে।
এইসব তথ্য থেকে নিঃসংশয় হওয়া যায় যে, মীর মশাররফ হোসেনই বরাবর হিতকরী পত্রিকার সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী ছিলেন। তবে টাঙ্গাইল-পর্বে কৌশলগত কারণে মোসলেমউদ্দীন খাঁকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব দিতে হয়। আর হিতকরীর শেষপর্বে রওশন আলী চৌধুরীর সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় হিতকরী প্রকাশের উদ্যোগ যে-কোনো কারণেই হোক সফল হয়নি। তবে হিতকরী চূড়ান্তভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো কুমারখালী থেকে যে বেশ কিছুদিন প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে মশাররফের রীতিমতো অনুমতি নিয়ে সম্পাদক হিসেবে পরিচিত হতে হয় জ্যোতিপ্রসাদ সান্যালকে। কিন্তু শেষপর্যন্ত হিতকরীর মালিকানা ও সম্পাদনা-স্বত্ব উভয়ই মশাররফেরই ছিল।
হিতকরী পাক্ষিক পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পাঠক-চাহিদার কারণে দ্বিতীয় বর্ষে ‘দাশাহিক’ বা ‘দাশহিক’ হিসেবে (অর্থাৎ দশদিন পরপর) প্রকাশিত হতে থাকে। এই পরিবর্তন ব্যতীত পত্রিকার মূল্য, মুদ্রাকর, প্রকাশক, মুদ্রণালয়, এজেন্ট বা অন্য কোনো নীতি-বক্তব্যের রদবদল হয়নি।
প্রজাহিতসাধনের লক্ষ্যে সৎ ও বস্ত্তনিষ্ঠ সাংবাদিকতার আদর্শ নিয়ে হিতকরীর আত্মপ্রকাশ। পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় পত্রিকা কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে (হিতকরী, ১০ বৈশাখ ১২৯৮) :
দুই দশ টাকা লাভের জন্য হিতকরী প্রকাশ হয় নাই। জীবিকা নিবর্বাহের কোন উপায় না পাইয়া এই কুটিল ও জটিলপথ আশ্রয় করা হয় নাই। ন্যায্য বলিব, সত্য প্রকাশ করিব। সত্যাশ্রয়ে থাকিব, সাধারণের হিতকরকার্য্যে অবশ্যই যোগ দিব। আমরা পূবর্ব হইতেই বলিয়া আসিতেছি যে, আমরা কোন সম্প্রদায়ভুক্ত নহি, আমরা সকলের। একচখো দৃষ্টি আমাদের নাই। যেখানে অন্যায়, সেইখানেই আমরা, যেখানে অত্যাচার, যেখানে অবিচার সেইখানেই আমাদের কথা! আমরা প্রশংসার প্রত্যাশী নহি। আর্থিক সাহায্যের আশাও রাখি না। সুতরাং আমাদের ভয়ের কোন কারণ নাই। প্রথম সূচনায় বলিয়াছি, আমাদের প্রথম পূজনীয় ঈশ্বর, তৎপরেই রাজা, গ্রাহকমাত্র না থাকুক, সাধারণে হিতকরী পাঠ না করুন, ক্ষতি নাই। যাঁহার নিকট জানাইলে দেশের উপকার হইবে, অত্যাচার অবিচার কমিবে, অন্যায়ের সুবিচার হইবে, কেবল তাঁহাকেই জানাইব। আর দেশের মান্যগণ্য লোক যাঁহাদের হৃদয় আছে, তাঁহাদের নিকট উপহারস্বরূপ উপস্থিত হইব। আর ভয় কি, কিসের আশঙ্কা।
এখানে লক্ষ করার বিষয় এই যে, রাজভক্তি ও রাজানুগত্যের প্রশ্নে হিতকরী তার যুগকে অস্বীকার বা অতিক্রম করতে পারেনি। তাই মূলত রাজদ্বারে আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে সমাজ ও জনগণের সমস্যা দূর করার প্রয়াসই অবলম্বন করেছিল হিতকরী।
বছরখানেক পত্রিকা প্রকাশের পর হিতকরীর পরিচালকদের এই অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় যে, স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে পত্রিকা পরিচালনা অত্যন্ত কঠিন। নানা সংকট, সমস্যা ও পারস্পরিক বিভেদ-দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও হিতকরী সবার শুভবুদ্ধি ও বিবেক-বিবেচনার কাছে ঐক্য ও সদ্ভাবের জন্যে আবেদন জানিয়েছে। সেই সঙ্গে জন্মলগ্নের অঙ্গীকারের কথা পুনরায় উচ্চারিত হয়েছে। হিতকরীর (২০ ভাদ্র ১২৯৮) এক ‘সম্পাদকীয় মন্তব্যে’ এই বিষয়গুলো যেন সালতামামির প্রতিবেদনের মতো পেশ করা হয়েছে :
হিতকরী যে গুরুতর ভার মাথায় করিয়া সাধারণ সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছে, যে পথে যে প্রণালীতে চলিতেছে তাহাতে তাহার প্রতিপত্তি লাভ করা সহজ নহে। এখানি হিন্দুর কাগজ, ওখানি ব্রাহ্ম পত্রিকা, ওখানি মুসলমান সমাজের মুখপত্র। এক একজন এক একজনের হইয়া কথা কহিতেছে। শুনিতেও মিষ্টি, চলিতেও সোজা পথ। কোনরূপ বাধা প্রতিবন্ধক কিছুই নাই। সকলের – সাধারণের হিতসাধনই হিতকরীর প্রধান উদ্দেশ্য। এবং ঐ পার্থক্যভাব দূর করার কথা মুখে আনা একপ্রকার পাগলের হেঁয়ালী। তবে একেবারে কাটাকাটি মারামারি না হইয়া ভ্রাতৃভাবে পরস্পর পরস্পরের দিকে কটাক্ষভাবে একবার দৃষ্টি করিলেও হিতকরীর জীবন সার্থক, জন্ম সফল। সকল দিক লক্ষ্য রাখিয়া আপন মস্তক বাঁচাইয়া, তেলে বেগুনে দা কুমড়ে, সদ্ভাব স্থাপন করিয়া প্রণয়ভাব বৃদ্ধি করা বড়ই কঠিন কার্য্য, নেহ্য নিরপেক্ষর সীমা হইতে একচুল পরিমাণ সরিবার ক্ষমতা হিতকরীর নাই। সুতরাং জাতিগত, সম্প্রদায়গত, ধর্ম্মগত কোনরূপ উত্তেজনা, কোনরূপ ইতরবিশেষে এমন কি উনিশ বিশে একটা বর্ণ উচ্চারণ করিবার ক্ষমতা হিতকরীর নাই। বাহবা পাইবার বরাত নাই। সহায় ঈশ্বর, ভরসা ঈশ্বর। আর অনুগ্রহ পাঠকগণের – মফস্বলে বাঙ্গালা খবরের কাগজ যাত্রার দলের সং বিশেষ -।
প্রেরণাশূন্য ও পৃষ্ঠপোষকতাহীন বৈরী সমাজে হিতকরীর চলার পথ সুগম ছিল না। অনেক বিরুদ্ধতা ও বিরূপ সমালোচনা সহ্য করে তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে হয়েছে। এই সমালোচনা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈরিতার রূপ নিয়ে শালীনতার গন্ডি অতিক্রম করেছে। কুষ্টিয়ার ছোটো আদালতের বিচারক ছিলেন বরদাপ্রসন্ন সোম। তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের খবর প্রকাশিত হওয়ায় ক্ষিপ্ত বিচারক প্রকাশ্য আদালতে হিতকরী পত্রিকাকে ‘পোঁদ পোঁছা কাগজ’ বলে কটূক্তি করেন এবং পত্রিকার সহকারী সম্পাদক উকিল রাইচরণ দাসকে ভৎর্সনা ও অপমান করেন। বিষয়টি এখানেই শেষ হয়নি – রাইচরণ দাসের বিরুদ্ধে বিচারক মহোদয় মোকদ্দমাও দায়ের করেন। এরপর ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে ‘জজবাবুর স্বপক্ষে লিখিবার জন্য হিতকরীর নিকট গোপনে প্রস্তাব হইল, সকলই বিফল’ (হিতকরী, ২০ ভাদ্র ১২৯৮)। সমাজের কল্যাণচিন্তা ও প্রগতিশীল ভূমিকার জন্যে হিতকরীকে কখনো কখনো রক্ষণশীল-মানসতার মানুষের বিরাগভাজন হতে হয়। সম্মতিদান আইন সমর্থন করায় অনেক গ্রাহক হিতকরীর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ এবং কেউ কেউ উত্তেজিত হয়ে গালমন্দ করে চিঠিও লেখেন (হিতকরী, ২০ বৈশাখ ১২৯৮)। এই ধরনের প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও হিতকরী কর্তৃপক্ষ স্বাধীন মতপ্রকাশ ও নির্ভীক ভূমিকা পালনের প্রতিশ্রুতি দিতে ও তা রক্ষা করতে দ্বিধা করেননি।
অবশ্য নিন্দা-সমালোচনার পাশাপাশি হিতকরীর প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষের আন্তরিকতার সন্ধানও মেলে। রায়ত-প্রজার অভাব-অভিযোগ এবং প্রশাসনিক ত্রুটি-বিচ্যুতি-অব্যবস্থার কথা নির্ভীকভাবে প্রকাশ করে হিতকরী যথার্থ সামাজিক কর্তব্য পালনে নিষ্ঠ থেকেছে – ‘জনৈক গ্রাহকে’র চিঠিতে (হিতকরী, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৮) এমন প্রশংসার কথা শোনা যায় :
ইতিপূবের্বও কয়েক সংখ্যাতে হিতকরীর প্রতি সাধারণের বিদ্বেষভাবের কথা প্রকাশিত হইয়াছে। হিতকরী কেন যে লোকের বিষ নয়নে পড়িতেছে কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।… হিতকরী ন্যায়ের পথ অবলম্বন করিয়া লোকসেবাব্রতে জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন। অত্যাচারীর অত্যাচার কাহিনী, অন্যায়ের প্রতিবাদ, ন্যায়ের সমর্থন, স্বদেশবাসীর মঙ্গলচিন্তা, এইসকল বিষয়ই তো হিতকরীতে দেখিতে পাই।… কুষ্টিয়ার বড়ই সৌভাগ্য বলিতে হইবে যে, হিতকরীর মত একখানি উচ্চ ও উদার মতের পত্রিকা প্রকাশিত হইয়া দেশের দুঃখকষ্টের কথা সাধারণ ও কর্ত্তৃপক্ষীয়দিগের নিকট জানাইতেছেন।
হিতকরীর বিরুদ্ধে ‘কোন ২ প্রস্তাবে প্রেরিত পত্রে সংবাদে মুসলমানি কথা থাকা’ বিষয়ে অভিযোগ উঠেছিল। এর যুক্তিসংগত জবাব দিয়ে হিতকরী (২০ ভাদ্র ১২৯৮) মন্তব্য করে : ‘…মাতৃভাষার সহিত ভ্রাতৃভাষার যোগ করিতেছি।… ভাষার মিলনে ভালবাসার বৃদ্ধি। ইহাও আমাদের কম সৌভাগ্যের কথা নহে।’
‘দ্বিতীয় বর্ষে ‘হিতকরী’ টাঙ্গাইলে স্থানান্তরিত হয়’, – ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (বাংলা সাময়িক-পত্র, ২য় খন্ড, কলকাতা, ১৩৫৯) পরিবেশিত এই তথ্য সঠিক নয়। দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত হিতকরী লাহিনীপাড়া থেকেই প্রকাশিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ‘নানা কারণে’ তৃতীয় বর্ষে হিতকরী টাঙ্গাইলে স্থানান্তরিত হয়। এই পর্যায়ের সূচনাতেও মশাররফ যে হিতকরীর সম্পাদক তা বেশ বোঝা যায়। টাঙ্গাইলে হিতকরী মুদ্রিত হতো বিশিষ্ট লেখক আবদুল হামিদ খান ইউসফজয়ীর আহমদী প্রেসে। পরে মশাররফ এই ছাপাখানার স্বত্বাধিকারী হন। মীরের অপ্রকাশিত দিনলিপি থেকে জানা যায়, ‘চাকরি নাই কেবল প্রেস লইয়া হিতকরী কাগজ লইয়া আছি।’
হিতকরী লাহিনীপাড়া থেকে টাঙ্গাইলে স্থানান্তর ও তার ফলে নিয়মিত প্রকাশনার সমস্যার কারণ ব্যাখ্যা করে মশাররফ তাঁর স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞাপনে নিজেকে ‘সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী’ হিসেবে উল্লেখ করেন (হিতকরী, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৯)। মীর-গবেষক আশরাফ সিদ্দিকী জানিয়েছেন, ১২৯৯ সালের ১০ ভাদ্র সংখ্যা হিতকরীতে সম্পাদক হিসেবে মোসলেমউদ্দীন খাঁ ও মুদ্রাকর হিসেবে সাধু সরকারের নাম ছাপা হয়। ওই সংখ্যায় সহকারী সম্পাদক ও এজেন্ট হিসেবে আগের মতোই কুষ্টিয়ার রাইচরণ দাসের নাম পাওয়া যায়। মশাররফ সম্পাদক হিসেবে যে পত্রিকার পরিচালক ছিলেন তার প্রমাণ পত্রিকা-অভ্যন্তরেই মেলে। পত্রিকায় দেলদুয়ার জমিদারবাড়ির কলহ-বিবাদের অনেক ঘরোয়া খবর প্রকাশিত হয়। মশাররফ তখন দেলদুয়ার এস্টেটের ম্যানেজার। এ-ছাড়া টাঙ্গাইলের কোনো কোনো সরকারি কর্মকর্তাও নানা কারণে মীরের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন। এসব কারণে স্বনামে পত্রিকা সম্পাদনা তাঁর পক্ষে নিরাপদ ছিল না। তাই তাঁর বিশ্বস্ত মোসলেমউদ্দীন খাঁকে সম্পাদনার দায়িত্ব অর্পণ করেন; – আশরাফ সিদ্দিকীর এই ধারণা যুক্তিযুক্ত বলেই মনে হয়। এই পর্যায়ে হিতকরী কতদিন চলেছিল তার সঠিক খবর জানা যায় না। তবে অনুমান করা চলে, মীরের টাঙ্গাইল-ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই এই পর্বের সমাপ্তি ঘটে। পরবর্তী সময়ে মোসলেমউদ্দীন খাঁর সম্পাদনায় হিতকরী পত্রিকা নবরূপে টাঙ্গাইল হিতকরী নামে প্রকাশিত হয় বলে কেউ কেউ মনে করেন। অবশ্য এই অনুমানের পক্ষে কোনো প্রমাণ মেলেনি। তবে ষাটের দশকে মিরজা আ. ম. আবদুল হাইয়ের সম্পাদনায় ‘টাঙ্গাইল মহকুমা মৌলিক গণতন্ত্রের মুখপত্র’ হিসেবে হিতকরী নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা (১৬ অক্টোবর ১৯৬২) প্রকাশিত হয়। পরে পত্রিকাটি মাসিকে রূপান্তরিত হয় এবং এই পর্যায়ে পত্রিকা-পরিচিতিতে মুদ্রিত থাকতো – ‘মাসিক হিতকরী (স্থাপিত ১৮৯২ – মীর মোশাররফ হোসেন)’।
টাঙ্গাইল-ত্যাগের সাত বছর পর মশাররফ পুনরায় কোহিনুর-সম্পাদক এস.কে.এম. মহম্মদ রওসন আলীর [রওশন আলী চৌধুরী] সহযোগে হিতকরী পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কোহিনুর পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষ (১৩০৬) শুরুর আগে প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপন-পুস্তিকার শেষভাগে হিতকরীর পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কে একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। এতে উল্লেখ করা হয় : ‘ ‘হিতকরী’ ১৩০৬ সালের শুভ বৈশাখ হইতে নতুন প্রণালীতে খাঁটি নিখুঁত মুসলমানীভাবে বাহির হইবে।’
৪র্থ বর্ষে নব-কলেবরে প্রকাশিত হওয়ার ওই বিজ্ঞাপন থেকে ধারণা করা যায়, ৩য় বর্ষে হিতকরী টাঙ্গাইলে মোটামুটি প্রায় এক বছর চলেছিল। অবশ্য টাঙ্গাইলে হিতকরী প্রকাশের সাত বছর পর পাংশা থেকে নবপর্যায়ে হিতকরী পত্রিকা ‘নতুন প্রণালীতে খাঁটি নিখুঁত মুসলমানীভাবে’ প্রকাশিত হওয়ার কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে ওই বছরেই (১৮৯৯) হিতকরী পত্রিকা যে হিন্দু-পরিচালক ও সম্পাদকের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়েছিল তার সাবুদ মেলে।
১৮৯৯ সালে (বাংলা ১৩০৬) চতুর্থ বর্ষের হিতকরী পত্রিকা পাক্ষিক হিসেবে প্রকাশের সুনির্দিষ্ট খবর পাওয়া যায় কাঙাল হরিনাথ-প্রতিষ্ঠিত কুমারখালীর মথুরানাথ যন্ত্রের ১৩০৭ সালের চিঠির নকল পুস্তক থেকে। হিতকরী এই পর্যায়ে কুমারখালীর মথুরানাথ যন্ত্রে মুদ্রিত হতো। মথুরানাথ যন্ত্রের মুদ্রাকর কুঞ্জলাল দাস Inspector General of Registration, Bengal-কে প্রেরিত প্রতিবেদন-পত্রে ১৮৯৯ সালে মুদ্রিত পুস্তক ও পত্রিকার মধ্যে উল্লেখ করেছেন, ‘Fortnightly newspaper ‘Hitakari’ 11 issues’. এই একই সালে ৪ খন্ড (‘4 parts’) কোহিনুর পত্রিকাও মুদ্রিত হয় এই প্রেস থেকে। এই পর্যায়ের হিতকরী মশাররফ হোসেন ও রওশন আলী চৌধুরীর যৌথ উদ্যোগের ফসল কিনা তা মশাররফের ডায়েরি, কোহিনুর পত্রিকা কিংবা মথুরানাথ যন্ত্রের পত্র নকল খাতা – কোনো সূত্র থেকেই জানা যায় না। তবে মথুরানাথ যন্ত্রের ১৩০৭ সালের চিঠির নকল পুস্তক থেকে হিতকরী পত্রিকা সম্পর্কে অন্য বিষয়ের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়।
বাংলা ১৩০৭ সালের (১৯০০ খ্রি.) ৫ম বর্ষের হিতকরীও যে মথুরানাথ যন্ত্রেই মুদ্রিত হয়, এই চিঠির নকল পুস্তক থেকে তার প্রমাণ মেলে। ৫ম বর্ষের হিতকরী ১৩০৭ সালের বৈশাখ মাস থেকে প্রকাশিত হয়। কুমারখালীর বিশিষ্ট চিকিৎসক, অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ও কবি নবদ্বীপচন্দ্র পাল হিতকরীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁকে লেখা মথুরানাথ যন্ত্রের মুদ্রাকর কুঞ্জলাল দাসের চিঠি থেকে নবপর্যায়ে ৫ম বর্ষের হিতকরীর প্রকাশনা-প্রস্ত্ততির আভাস পাওয়া যায় :
হিতকরীর সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী মহাশয়ের সহিযুক্ত আদেশপত্র না পাইলে আমার মুদ্রাযন্ত্র হইতে হিতকরী ছাপাইতে গেলে আমাকে ‘প্রেস এক্ট’ অনুসারে দায়ী হইতে হইবে। অতএব নিবেদন অতঃপর হিতকরীর কাপি দিতে হইলে বা সংশোধন করিতে হইলে উপযুক্ত ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির স্বাক্ষর আবশ্যক। শ্রীযুক্ত জ্যোতিবাবু [জ্যোতিপ্রসাদ সান্যাল] সম্পাদক বা স্বত্বাধিকারী বলিয়া পরিচিত নহেন। অতএব তাঁহার দস্তখত আইনসঙ্গত নহে। যদি আমাকে তাঁহার দস্তখত গ্রহণ করিতে হয় তবে তাঁহাকে ঐরূপে পরিচিত হওয়া আবশ্যক। নতুবা এ প্রকার দায়ীত্বহীন পত্র ছাপাইয়া আমি বিপদগ্রস্ত হইব। এই ভয়ে আপনাকে সমস্ত জানাইলাম। সত্বরে বিহিত বিধান করিয়া বাধিত করিবেন। (১০ সংখ্যক চিঠি : ৮ বৈশাখ ১৩০৭)
এই চিঠি থেকে বেশ বোঝা যায়, নবদ্বীপচন্দ্র পাল বা জ্যোতিপ্রসাদ সান্যাল নন, তৃতীয় একজন হিতকরীর সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী ছিলেন এবং তিনি মীর মশাররফ হোসেন।
১৩০৭ সালের ৩০ বৈশাখের এক পত্রে জ্যোতিপ্রসাদ সান্যালকে হিতকরীর সম্পাদক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে মনে হয়, ইতোমধ্যে তিনি হিতকরীর প্রকৃত স্বত্বাধিকারীর কাছ থেকে নিয়মমাফিক সম্পাদকের দায়িত্বপালনের অনুমতি লাভ করেছেন। এই চিঠিতে মুদ্রাকর কুঞ্জলাল দাস মথুরানাথ মুদ্রাযন্ত্রে হিতকরী পত্রিকা মুদ্রণে অপারগতার কথা জানিয়ে দেন (২৮ সংখ্যক চিঠি : ৩০ বৈশাখ ১৩০৭)। অবশ্য এর পরপরই একই তারিখে ছাপাখানার স্বত্বাধিকারী কাঙাল হরিনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র সতীশচন্দ্র মজুমদারের আরেকটি চিঠিতে ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। চিঠিতে জানা যায়, কাঙাল হরিনাথ সম্পর্কে ‘কতিপয় দুঃখজনক কথা শ্রুতিগোচর হওয়ায়; স্বত্বাধিকারী ও প্রেসের কর্ম্মচারীদের মনের আবেগহেতু ঐরূপ পত্র লিখিত হইয়াছিল’। পত্রিকার মূল প্রেসকপি ছাপাখানায় সংরক্ষণ প্রশ্নে প্রেস ও পত্রিকা কর্তৃপক্ষের মধ্যে একসময় মতভেদ দেখা দেয়। প্রেসের পক্ষ থেকে বিষয়টির সুরাহার জন্যে হরিনাথের দুই সাহিত্যশিষ্য অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও জলধর সেনের পরামর্শ ও নির্দেশনা চাওয়া হয়।
এই পর্যায়ে প্রকাশনার পঞ্চম বর্ষে, হিতকরী ১৩০৭ সালের শেষভাগ পর্যন্ত যে প্রকাশিত হয়েই ছিল তার প্রমাণ আছে এই চিঠির নকল পুস্তকে। এই খাতার কীটদষ্ট শেষ চিঠিটিও (ফাল্গুন ১৩০৭) হিতকরী-সম্পর্কিত। এখানে জ্যোতিপ্রসাদ সান্যালের পরিচয় মেলে হিতকরীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে। একাধিক চিঠিতে স্বত্বাধিকারী ও সম্পাদক [দায়িত্বপ্রাপ্ত] যে ভিন্ন ব্যক্তি সেই উল্লেখ আছে। তবে পরের বছর অর্থাৎ ১৩০৮ সালেও হিতকরীর প্রকাশনা অব্যাহত ছিল কিনা কোনো সূত্রেই তা জানার সুযোগ পাওয়া যায়নি।
পূর্ববর্তী সময়ে হিতকরী মুদ্রণের জন্যে মথুরানাথ যন্ত্রের অর্থ-পাওনা ছিল মীর মশাররফ হোসেনের কাছে। কোহিনুর-সম্পাদক এস.কে.এম. রওশন আলীর বকেয়া আদায়ের জন্যে বারবার প্রেস থেকে তাগিদ-পত্র পাঠানো হয়, তারই একটিতে এর উল্লেখ মেলে। অসহিষ্ণু ও বিরক্ত প্রেস-পরিচালক কড়া ভাষায় জানান :
২৭/২৮ বৎসর প্রেসের কাজ হইতেছে, কিন্তু এ পর্য্যন্ত লোকের নামে নালিশ করিয়া টাকা আদায় করিতে হয় নাই। এক মীর মশাররফের সঙ্গে আর আপনার সঙ্গে করিতে হইতেছে, সে বোধ হয় এক জাতীয়তার স্বভাব। (৬৪ সংখ্যক পত্র : ২২ আষাঢ় ১৩০৭)
খাস-তথ্য পাওয়া না গেলেও ১৩০৭ সালের পর হিতকরী প্রকাশের সম্ভাবনা নানা বিবেচনায় একেবারে নাকচ করা যায় না। তবে এটুকু নিশ্চিত বলা যায়, ১২৯৭, ১২৯৮, ১২৯৯, ১৩০৬ ও ১৩০৭ – এই পাঁচ বছর হিতকরী চলেছিল, তবে তা বিরতিহীনভাবে নয়। কিন্তু ১৩০০ থেকে ১৩০৫ – এই ছয় বছর হিতকরীর প্রকাশ পুরোপুরি বন্ধ ছিল বা অনিয়মিত বের হতো কিনা সে-তথ্য অজ্ঞাত। এছাড়া এ-রহস্যেরও সমাধান হয়নি, হিতকরী পূর্বঘোষিত যৌথ সম্পাদনায় ‘খাঁটি নিখুঁত মুসলমানীভাবে’ না বেরিয়ে হিন্দু-সম্পাদকের তত্ত্বাবধানে কেন প্রকাশিত হয়েছিল! বেশ বোঝা যায়, হিতকরীর অন্তিম-পর্বে জীবন-জীবিকার সংকটে জর্জরিত মশাররফের পত্রিকা-বিষয়ে তেমন আগ্রহ-উৎসাহ বা কোনো সক্রিয় ভূমিকা ছিল না, যদিও খাতা-কলমে তিনিই ছিলেন এই পত্রিকার স্বত্বাধিকারী।
হিতকরী উনিশ শতকের শেষ দশকের গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা – স্বতন্ত্র চরিত্রের এবং ভিন্ন মেজাজের। জাতিবৈর-অসহিষ্ণু সমাজ-পরিবেশে হিতকরী নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি ও সম্প্রদায়-সম্প্রীতির মনোভাব নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। আর্থিক ক্ষতি, গোষ্ঠীগত বিদ্বেষ, সামাজিক বিরূপতা স্বীকার করে নিয়েও পত্রিকাটি সামাজিক সংকট-সমস্যার প্রতিফলন, লোককল্যাণ ও জনমত-গঠনে প্রশংসাযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি মনোযোগী ও কর্তব্যনিষ্ঠ হয়েও, ভিন্ন সম্প্রদায়কেও যে আপন করা যায়, প্রীতিবন্ধনে আবদ্ধ করা সম্ভব – সে-কথাটি যেমন লেখক মীর মশাররফ হোসেন অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতেন, তেমনই তাঁর পত্রিকা হিতকরীও সেই মিলনের বার্তাই পূর্বাপর ঘোষণা করেছে।
হিতকরীতে মূলত স্থানীয়-জাতীয়-বিবিধ-বহির্বিশ্বের সংবাদ, পীড়িত মানুষের অভাব-অভিযোগের চিঠিপত্র, সম্পাদকীয় মন্তব্য ও উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ এবং কখনো কখনো-বা সাহিত্যধর্মী রচনাও প্রকাশিত হতো। এইসব রচনায় লেখকের নাম সাধারণত মুদ্রিত হতো না। তবে ভাষাভঙ্গি ও বিষয়-নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে এই অস্বাক্ষরিত অনেক রচনারই যে লেখক ছিলেন মীর মশাররফ হোসেন তা বেশ অনুমান করা চলে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ-বিষয়ে পত্রিকার সহ-সম্পাদক রাইচরণ দাসের নামও এসে যায়। মশাররফ ছিলেন উদার মন ও মতের লেখক। স্বদেশ ও সমাজ সম্পর্কে গভীর মনোযোগের পরিচয় তাঁর অনেক লেখাতেই পাওয়া যায়। অসাম্প্রদায়িক চেতনা তাঁর চরিত্রের আর-এক বিশেষ গুণ। তাঁর পরিচালিত পত্রিকায় সংগত কারণেই এইসব বৈশিষ্ট্যের সাক্ষাৎ মেলে। মশাররফের চিন্তা-চেতনা কীভাবে হিতকরী পত্রিকায় তাঁর নানা লেখা বা মন্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে সেই বিষয়টি বিশেষ অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে উদ্ঘাটন করেছেন মীর-গবেষক শামসুজ্জামান খান (‘মীর মশাররফ হোসেন : নতুন তথ্যে নতুন ভাষ্যে’, ঢাকা, ১৪১০)। সামগ্রিকভাবে হিতকরী পত্রিকায় প্রকাশিত নানা নিবন্ধ, সংবাদ বা সম্পাদকীয় মন্তব্যে বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতি, দুর্দশা-দুঃখ, সমস্যা-অভিযোগ ও জীবন-জীবিকার নানা সংকটের পরিচয় প্রতিফলিত। হিতকরীর সূত্রে উনিশ শতকের অন্তিমপর্বের বাংলার সমাজ-অর্থনীতি-শিক্ষা-রাজনীতি-ধর্ম-ভাষা-সাহিত্যের অন্তরঙ্গ পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়।
গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার আদলে-আদর্শে ও কাঙাল হরিনাথের প্রেরণায় মশাররফ হিতকরী প্রকাশ করেন। গ্রামের কাগজ গ্রামবার্ত্তা যথার্থই পল্লির জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ছিল। এই পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে পল্লিবাসী এর অভাব গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। উত্তরকালে যেসব পত্র-পত্রিকা এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত হয়, তা গ্রামবার্ত্তার যথার্থ বিকল্প হতে পারেনি। মীর মশাররফের হিতকরী পত্রিকায় (২৬ আগস্ট ১৮৯১) ‘পল্লীবাসী প্রজা’র নামে প্রকাশিত একটি চিঠিতে একজন পত্রলেখক গ্রামবার্ত্তার সঙ্গে হিতকরীর তুলনা এবং এই পত্রিকার কাছে গ্রামীণ মানুষের দাবি ও প্রত্যাশার কথা জানিয়ে লিখেছেন :
আজ কয়েক বৎসর হইতে গ্রামবার্ত্তার কণ্ঠ নীরব হইয়াছে। গ্রামবার্ত্তার সতেজ লেখনী প্রভাবে এ অঞ্চলের পুলিশ, বিচারক, হাকিম, মিউনিসিপ্যাল কমিশনার, জমীদার প্রভৃতির অত্যাচার শান্তভাব ধারণ করিয়াছিল। গ্রামবার্ত্তার জীবন এই সমস্ত অত্যাচার কাহিনী প্রকাশ করিয়া অনেক সময় নানা বিপদে পড়িতে হইয়াছিল যে তাহার আর উল্লেখের প্রয়োজন নাই; এ প্রদেশের সকলেরই অন্তরে তাহা জাগরিত রহিয়াছে।… তাই আমাদের নিবেদন গ্রামবার্ত্তার কণ্ঠ নীরবের পর যখন হিতকারী অভ্যুদয় হইয়াছে; তখন আমরা পল্লীবাসী আমাদের দুঃখের কথা গ্রামবার্ত্তায় যেমন তীব্রভাবে আলোচিত হইয়া রাজার গোচর করিত, সেইরূপ আলোচিত হইয়া আমাদের দুঃখ দূর করিতে চেষ্টা করুন।… পূবের্ব যখনই দুঃখ পাইতাম তখনই গরীবের দুঃখের দুঃখী, কান্নায় সমভাগী গ্রামবার্ত্তার দ্বারে গিয়া কতবার কাঁদিতাম। স্বকরুণ স্বরে আমাদের জন্যে কত কান্নাই সম্পাদক রাজার নিকট, জমীদারের নিকট কাঁদিয়াছেন; কিন্তু এখন কাহার কাছে যাইব?… গ্রামবার্ত্তার স্থানে আবার হিতকারীকে আমরা দেখিতে পাইয়া গ্রামবার্ত্তার অভাবকষ্ট ভুলিয়া যাইব।
নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও হিতকরী ‘পল্লীবাসী প্রজা’-সাধারণের প্রত্যাশা যে অনেকখানি পূরণ করতে পেরেছিল, তা কবুল করতেই হয়।
বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে – বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানের প্রয়াসের ক্ষেত্রে মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত-পরিচালিত আজীজন নেহার ও হিতকরী পত্রিকার বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য আছে। এই দুটি আঞ্চলিক পত্র কল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, জনসচেতনতা সৃষ্টি ও গ্রামীণ মানুষের স্বার্থরক্ষায় যে উদ্যোগ-গ্রহণ ও ভূমিকা-পালন করেছে, তা সমকাল ও উত্তরকালের কোনো কোনো পত্র-পত্রিকার আদর্শ ও প্রেরণা হতে পেরেছিল। নিরপেক্ষ ও সৎ-সাংবাদিকতা, লোককল্যাণের প্রয়াস, পল্লি-উন্নয়নের চিন্তা, সম্প্রদায়নির্বিশেষে সমদর্শী-দৃষ্টিভঙ্গি, প্রয়োজনবোধে সরকার-প্রশাসন-জমিদারের সমালোচনা এবং স্বাধীন মতপ্রকাশে নির্ভীকতা আজীজন নেহার ও হিতকরী পত্রিকা ও এর স্বত্বাধিকারী-পরিচালক মীর মশাররফকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে।
আজীজন নেহার ও হিতকরী দুটি পত্রিকাই এখন অতি দুষ্প্রাপ্য। যাঁরা সাময়িকপত্রের ইতিহাস রচনা করেছেন এবং মীর মশাররফ হোসেন সম্পর্কে লিখেছেন তাঁদের মধ্যে একালে -একজন হিতকরী পত্রিকা দেখলেও, আজীজন নেহার দেখার সুযোগ-সৌভাগ্য তাঁদের হয়নি – এমন কী ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়েরও নয়। আজীজন নেহার সম্পর্কে তাই আমাদের জ্ঞান মূলত সেকালের পত্রিকা-নির্ভর। তারই আলোকে এই পত্রিকার বৈশিষ্ট্য ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আমরা কিছু ধারণা পাই : ক. সমাজহিতকামনা, খ. বাংলাভাষার প্রতি অনুরাগ, গ. হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি, ঘ. জাতীয়তা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার সংশোধন। গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় (আষাঢ় ১২৮১) এই পত্রিকার হিতকামী উদ্দেশ্যের প্রতি স্বাগত জানিয়ে বলা হয়, আজীজন নেহারের মাধ্যমে সমাজ-সমস্যার ‘কিছু না কিছু নিরাকৃত হইবে’, বিশেষ করে ‘তাহা মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষে অতি উপাদেয় ফল বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে’। লেখক হিসেবে আবির্ভাবের সূচনাতেই মশাররফ ‘বিশুদ্ধ বাঙ্গালাভাষা’-চর্চার জন্যে হিন্দু-পরিচালিত পত্র-পত্রিকার যে-প্রশংসা ও অভিনন্দন লাভ করেছিলেন, সম্পাদিত প্রথম পত্রিকার ক্ষেত্রেও সেই একই স্বীকৃতি জুটেছিল। আজীজন নেহার পত্রিকার ভাষা সম্পর্কে গ্রামবার্ত্তা (আষাঢ় ১২৮১) উল্লেখ করেছিল : ‘ভাষা অতি মনোরম। মুসলমান লিখিত বলিয়া মনে হয় না, এমন কি অনেক আধুনিক হিন্দু লেখকের লিপি-চাতুর্য্যকে ইহার নিকট বলিদান দিতে পরামর্শ দি’। এডুকেশন গেজেটের (১ মে ১৮৭৪) এক পত্রলেখক বাঙালি মুসলমান ‘মধুময় বাঙ্গলা ভাষার যথার্থ স্বাদগ্রহণে সমর্থ হইয়াছেন’ – এই দেখে উৎফুল্ল হয়েছেন। ওই পত্রিকাতেই (৮ মে ১৮৭৪) আবার বলা হয়, মুসলমান-পরিচালিত হলেও ভাষায় ‘মুসলমানি বাঙ্গালার নামগন্ধ নাই, বিশুদ্ধ বাঙ্গালার রীতিতে লিখিত’। সোমপ্রকাশও (১৮ মে ১৮৭৪) একই সুরে বলেছে : ‘ইহার ভাষা অনেক বিজ্ঞ বিজ্ঞ সম্পাদকের ভাষার অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট’। মশাররফ বরাবর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যের পক্ষে ছিলেন – সাহিত্যের মতো সাময়িকপত্র-পরিচালনাতেও। আজীজন নেহার মুসলমান-পরিচালিত পত্রিকা হলেও এতে হিন্দু সম্প্রদায়েরও যোগ ও সম্পর্ক ছিল। সাধারণীর (৮ জুন ১৮৭৪) সূত্রে জানা যায় : ‘আজিজন নেহারে দুইজন বাঙ্গালী হিন্দু লেখকও এজেন্ট বলিয়া পরিচিত হইয়াছেন’। দ্বিতীয় পত্রিকা হিতকরী পরিচালনায় হিন্দুসমাজের সম্পৃক্ততা ছিল আরো বেশি।
দুষ্প্রাপ্য বলে আজীজন নেহারের কোনো রচনার স্বাদ গ্রহণের সুযোগ আজকের দিনের পাঠকের নেই। শুধু সামান্য একটু অংশই রক্ষা পেয়েছে এডুকেশন গেজেটের (১১ ডিসেম্বর ১৮৭৪) কল্যাণে – ‘এ দেশের মুসলমানেরাও বাঙ্গালী’ শীর্ষক নিবন্ধে আজীজন নেহারের একটি রচনার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করার ফলে। রচনাংশটি বাঙালি মুসলমানের জাতিসত্তা ও মাতৃভাষার প্রশ্নে নেতিবাচক মনোভাব ও প্রচলিত সংস্কারের বিপক্ষে এক সাহসী ও নির্ভুল সিদ্ধান্তের স্বাক্ষর হিসেবে গ্রাহ্য হওয়ার যোগ্য :
আমরা মুক্তকণ্ঠে সংবাদপত্রে স্বীকার করিয়াছি, আমরা বাঙ্গালী, বাঙ্গালা আমাদের মাতৃভাষা, আমরা কি আমাদের অবমাননা করিয়াছি? কোন দেশে পুরুষানুক্রমে বাস করিয়া তদ্দেশীয় বলিয়া পরিচয় দেওয়া দেশীয় ভাষা ব্যবহার করা অবমাননার বিষয় নহে; পরন্তু বীর্য্যবান দেশাদি মাতৃভূমি ভাণ করিয়া তাহাদের বিকৃতিপ্রাপ্ত ভাষা ব্যবহার করা উপহাস-সঞ্চারক। ইহাও অল্প রহস্যের বিষয় নহে, প্রকৃত মাতৃভূমির প্রতি ঘৃণা করিয়া পশ্চিমদিক্বাসী বলিয়া পরিচয় দিতে পারিলে গৌরব বিবেচনা করি।… যাহা হউক, আমরা বাঙ্গালী বলাতে আমাদের অবমাননা হয় নাই…।
একশ একচল্লিশ বছর আগে স্বদেশ-মাতৃভাষা-জাতীয়তার প্রশ্নে বিভ্রান্ত রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমান সমাজের কোনো প্রতিনিধির কণ্ঠে এমন প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ প্রায় অসম্ভব ও অকল্পনীয় বলে মনে হবে। এদিক দিয়ে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে মশাররফকে বাংলার ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রবক্তা বলে স্মরণ করতে হয়। উত্তরকালে মশাররফ তাঁর পরিচালিত পত্রিকা হিতকরী এবং সাহিত্যচর্চায় সম্প্রদায়-সম্প্রীতি, সমাজমনস্কতা, দেশ ও ভাষাপ্রীতির প্রশ্নে আরো প্রাজ্ঞ ও পরিণত হয়েছেন – বোধ-বিশ্বাস-চেতনায় আরো দৃঢ় হয়েছেন। নিবিড় পর্যালোচনায় এই নিরিখে বলা যায়, এসবকিছুর মূলে তাঁর প্রধান ও প্রথম ঋণ বোধহয় তাঁর পরিচালিত সাময়িকপত্রের কাছে।
তথ্যঃ আবুল আহসান চৌধুরী