লালন শাহ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধকদের মধ্যে একজন। তিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ ইত্যাদি নামে পরিচিত। লালন শাহ একাধারে একজন সাধক, দার্শনিক, মানবতাবাদী, গীতিকার ও সুরকার। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে তাকে ‘বাউল সম্রাট’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
তবে এখনও পর্যন্ত লালনকে নিয়ে একটি বিষয় অমীমাংসিত থেকে গেল। তা হলো তিনি জন্মসূত্রে কী ছিলেন, হিন্দু না মুসলমান? এ ব্যাপারে নানা রকম তর্ক-বিতর্ক ও মতভেদ রয়েছে।
লালনের জীবন সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে তাঁর গানগুলোতে তাঁর সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। কিন্তু লালনের কোনো গানে তাঁর জীবন সম্পর্কে তিনি কোনো তথ্য রেখে যাননি। কয়েকটি গানে তিনি নিজেকে ‘লালন ফকির’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত ‘হিতকরী’ পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, “ইহার জীবনী লিখিবার কোনো উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছু বলিতেন না। শিষ্যরা তাহার নিষেধক্রমে বা অজ্ঞতাবশত কিছুই বলিতে পারে না।” তথাপি কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র ব্যতিরেকেই একটি সূত্রে তাকে হিন্দু কায়স্থ হিসেবে বর্ণনা করেছে। ড. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেছিলেন, লালন ছিলেন জন্মসূত্রে একজন কায়স্থ হিন্দু এবং তার জন্মস্থান ছিল কুমারখালীর অপর পারে গড়াই নদী তীরবর্তী ভাঁড়ারা গ্রামে। যদিও লালন হিন্দু না মুসলমান এই কৌতূহল ও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে জীবদ্দশায়।
অবশ্য অনেকেই আবার তাকে মুসলমান বলে মনে করেন। যেসব গবেষক লালনকে মুসলমান বলে মনে করেন, তারা লালনের জন্মস্থান হরিশপুরসহ পিতামাতা, আত্মীয়-পরিজনের পরিচয়ও নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করেছেন। লালন নিজে অবশ্য নিজের সম্পর্কে কিছুই বলেননি, এমনকি ভুলক্রমে গানের কোথাও কোনোরূপ পরিচিতি প্রকাশ হয়ে পড়ে এ বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন। তিনি তাঁর গানে সব ধর্মীয় পরিচয়কে অস্বীকার করে নিজেকে জাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। তিনি তাঁর গানে লিখেছেন—
“সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কি রূপ
দেখলাম না এই নজরে।।
কেউ মালায় কেউ তসবি গলায়,
তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়।
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়,
জাতের চিহ্ন রয় কার রে।। ”
তবে লালনের জাত-পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ওঠার কারণ হিসেবে কিছু কেচ্ছা-কাহিনীকে অনেকে দায়ী করেন। পারিপার্শ্বিক প্রচলিত ধারণা থেকে অনুমিত হয়েছে যে, লালন হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, কিন্তু ছেলেবেলায় জলবসন্ত রোগে অসুস্থ অবস্থায় তাঁর পরিবার তাঁকে ভেলায় ভাসিয়ে দেয়। তখন মলম শাহ এবং তার স্ত্রী মতিজান নামের এক মুসলমান দম্পতি তাঁকে আশ্রয় দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। মলম শাহ তাঁকে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য ফকির সিরাজ সাঁই নামের একজন ফকিরের কাছে পাঠান
লালনের সমসাময়িক হিন্দু সমাজ ছিল অত্যন্ত কঠোর। মুসলমান দম্পতির কাছ থেকে ভাঁড়ারায় ফিরে গিয়ে তিনি দেখলেন, তিনি কঠিনভাবে সমাজচ্যুত। হয়তো প্রায়শ্চিত্তের কোনো ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু নিজের সমাজের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা ও ক্ষোভে এবং অভিমান নিয়ে লালন ফিরে এলেন ছেঁউড়িয়ায় তার মুসলমান আশ্রয়দাত্রীর কাছে। সমাজ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করল। তিনিও রক্ত-ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে পরিণত হলেন এক নবজাত-লালনে। যৌক্তিক দিক থেকে এ ধরনের আত্মগোপনতাই স্বাভাবিক বলে ধারণা করা হয়। ‘হিতকরী’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে এ তথ্য জানা যায়।
বস্তুতপক্ষে লালন কোনো বিশেষ ধর্মে বিশ্বাস না করে মানবতাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু সব ধর্মের লোকের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। মুসলমানদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্কের কারণে অনেকে তাকে মুসলমান বলে মনে করত। আবার বৈষ্ণব ধর্মের মত পোষণ করতে দেখে হিন্দুরা তাঁকে বৈষ্ণব মনে করত। প্রকৃতপক্ষে লালন কোনো জাতিভেদ মানতেন না। তবে তিনি শ্রীকৃষ্ণের অবতার বিশ্বাস করতেন বলে কারও কারও কাছে জানা যায়। তার জন্মতারিখ নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। তবে তাঁর জন্মতারিখ নিয়ে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। একদল গবেষক মনে করেন, লালন সাঁইয়ের জন্ম ১৭৭৪ সালে। অন্য দলের অভিমত ১৭৭২ সালের ১৪ অক্টোবর। পরস্পরবিরোধী মত প্রচলিত আছে তাঁর জন্মবৃত্তান্ত নিয়েও।
লালন শাহের ওপর বিশিষ্ট লোকগবেষক ও চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার একটি নিবন্ধে লিখেছেন, “ফকির লালন শাহ কবে কোথায় কার ঘরে কীভাবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই তথ্য কারোরই জানা নেই। কিন্তু তার পরও তাঁর তিরোধানের পর থেকে কেউ তাঁকে হিন্দু আর কেউ মুসলমান বলে লাঠালাঠি কম করেনি। লালন নিজের পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন করে যাওয়ার পরেও কুটিল সাম্প্রদায়িকতা তাকে ক্রমাগত মলিন করে দিতে চেয়েছে বারবার। কখনও না জেনে, কখনও সজ্ঞানে। যিনি নিজের জীবদ্দশায় সজ্ঞানে ও সচেতনভাবে নিজের পরিচয় অপ্রকট করে গিয়েছেন তাঁর গায়ে আবার সাম্প্রদায়িক পরিচয় সেঁটে দেয়া কেন? কেন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যে তিনি জন্মসূত্রে একজন হিন্দু? এমনকি তার জাতিও কেন নির্ণয় করে বলে দিতে হবে যে তিনি কায়স্থ ঘরের সন্তান? সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন শুধু জাতপাতবিরোধী গান লিখে নয়, নিজের পরিচয় গোপন বা লুপ্ত করে দেয়ার সাধনা দিয়েও। বাংলার ভাবান্দোলনের দিক থেকে এর ভাবগত তাত্পর্য এবং সেই তাত্পর্যের রাজনীতি অনুধাবন বরং এই কালে অনেক বেশি জরুরি।
তাঁর জীবিতকালে তাঁর জাতিগোষ্ঠীর অন্য লোকজন তো কুষ্টিয়াতেই থাকার কথা। কিন্তু কেউ জানল না লালনের মা কে, বাপ কে? কোন পরিবারে তাঁর জন্ম? মীর মশাররফ হোসেনের ‘হিতকরী’ লোকমুখের গল্পকেই সততার সঙ্গে লোকমুখের কেচ্ছা বলেই প্রকাশ করেছে।”
লালনকে ‘হিন্দু’ প্রমাণ করার প্রত্যক্ষ কুফল হচ্ছে পাল্টা তাকে ‘মুসলমান’ বানানোর চেষ্টা। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে এটা মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার চেহারা। এ সম্পর্কে সুধীর চক্রবর্তী খুব উষ্মার সঙ্গে তাঁর ‘ব্রাত্য লোকায়ত লালন’ বইয়ে আলোচনা করেছেন। সুধীর চক্রবর্তী লিখছেন, “কিন্তু ইতোমধ্যে ঘটে গেছে একটা বড়ো মত বদলের পালা, বিশেষত বাংলাদেশে। ১২৯৭ সালের ‘হিতকরী’র সম্পাদকীয় নিবন্ধ থেকে লালন ফকিরের যে জীবনী এবং তাঁর হিন্দু উেসর কথা সবাই জানতেন, সে সম্পর্কে সংশয় সন্দেহ ঘনাতে শুরু হয়েছে পঞ্চাশ দশকে। ১৩৩৫ সালে বসন্তকুমার পাল লালন ফকিরের বিস্তৃত পরিচিতি লেখেন ‘প্রবাসী’ পত্রে। পরে পূর্ণাঙ্গ বই ‘মহাত্মা লালন ফকির’ লেখেন ১৩৬২ সালে। মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, মতিলাল দাস প্রমুখ অগ্রণী লালন-গবেষক সবাই সেই জীবন বিবরণ জানতেন এবং মানতেন যে লালন ভাঁড়ারা গ্রামের অর্থাত্ কুষ্টিয়ার মানুষ, জন্মগত হিন্দু কিন্তু নানা ঘটনাপরম্পরায় তিনি হয়ে যান জাতিহীন বাউল বা ফকির। কিন্তু একদল নতুন গবেষক বলতে চাইলেন লালন জন্মসূত্রেই মুসলমান।” [চক্রবর্তী ১৯৯২; পৃ. ৩০-৩১]
সুধীর চক্রবর্তী লালনের যে দিকটা উপেক্ষা করছেন সেটা হচ্ছে, বসন্তকুমার পালের বানানো কেচ্ছাটাই অন্যরা জানতেন ও মানতেন। এই কাহিনীর পাল্টা আরেকটি কাহিনী বানানো হচ্ছে আদিতে লালনকে হিন্দু বানিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষ বপন করা হয়েছিল বলেই। আর দুই সাম্প্রদায়িক ধারার মাঝখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে লালনের ভক্ত, অনুরাগী, অনুসারীরা।
বস্তুত লালন শাহ এককভাবে না ছিলেন সাধক, না তাত্ত্বিক, না বাউল। তিনি ধর্ম প্রচারকও নন, সংস্কারকও নন। শুধু তিনি লোকজীবনে বিভিন্ন ধর্মের সমন্বয়ের প্রয়াস পেয়েছিলেন। তিনি এও বলেছেন—
‘ধর্মা ধর্ম বলিতে কিছু নাই তাতে
প্রেমের গুণ গায়।’
তবে লালন শাহ এক উদার অভিনব শাস্ত্রবিহীন মানবতাবাদী ধর্মের পোষক। লালন তাই জাত-ধর্মের সীমাবদ্ধতার ওপর তীব্র আঘাত হানেন তার গানে—
জাত না গেলে পাইনে হরি
কি ছার জাতের গৌরব করি
ছুঁসনে বলিয়ে।
লালন কয় জাত হাতে পেলে
পুড়াতাম আগুন দিয়ে।
লালনকে নিয়ে আরও একটি মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ তাঁকে আউলিয়া হিসেবে আখ্যায়িত করেন। লালন মুসলমান ছিলেন না। জীবনে কখনও নামাজ-রোজার ধার ধারেননি, চৈত্র মাসের দোল পূর্ণিমাকে গ্রহণ করেছেন তার বার্ষিক পুণ্যযজ্ঞের রজনীরূপে, তাঁর আউলিয়া হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না; অথচ এসব অভিধায় আজ তাকে অভিহিত করা হচ্ছে।
আধ্যাত্মিক ভাবধারায় লালন প্রায় ছয় হাজার গান রচনা করেছিলেন। তাঁর গানে মানবজীবনের রহস্য, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর রচিত গান তাই উভয় ধর্মের কাছে সমান সমাদৃত। ব্রিটিশ আমলে যখন হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে জাতিগত বিভেদ-সংঘাত বাড়ছিল, তখন লালন ছিলেন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তিনি তাঁর প্রতিটি গানে নিজেকে ফকির হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। লালন ফকির সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন—“লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন—আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।”
রবীন্দ্রনাথ কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার শিলাইদহে অবস্থানকালে লালন শাহের কাছ থেকে ২৯৮টি গান সংগ্রহ করে ২০টি গান প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ করেন। সেখান থেকেই শিক্ষিত সমাজে লালনের পরিচয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাঁর সহস্রাধিক গান সংগৃহীত হয়েছে। মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন একাই তিন শতাধিক লালনগীতি সংগ্রহ করেছেন, যা তাঁর হারামণি গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে। এ ছাড়াও তাঁর অন্য দু’টি গ্রন্থের শিরোনাম যথাক্রমে ‘লালন ফকিরের গান’ এবং ‘লালন গীতিকা’; যাতে লালনগীতি সঙ্কলিত হয়েছে।
লালনকে নিয়ে কয়েকটি চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ হাসান ইমাম পরিচালনা করেন ‘লালন ফকির’ চলচ্চিত্রটি। ম. হামিদ ১৯৮৮ সালে পরিচালনা করেন তথ্যচিত্র ‘দ্যাখে কয়জনা’। তানভীর মোকাম্মেল ১৯৯৬ সালে পরিচালনা করেন তথ্যচিত্র—‘অচিন পাখি’। ২০০৪ সালে তানভীর মোকাম্মেলের পরিচালনায় ‘লালন’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। এছাড়া ২০১০ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে গৌতম ঘোষ ‘মনের মানুষ’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যা ২০১০ সালে ৪১তম ভারত ফিল্ম- ফেস্টিভ্যালে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার অর্জন করে।
লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়াতে একটি আখড়া তৈরি করেন, যেখানে তিনি তাঁর শিষ্যদের নীতি ও আধ্যাত্মিকতা শিক্ষা দিতেন। জীবনের শেষ অংশ তিনি এই আখড়ায় কাটান। লালন সাঁইয়ের মৃত্যু হয় ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর। অনেকের মতে, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ১১৬ বছর। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী আখড়ার একটি ঘরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। লালনের মৃত্যুর পর তত্কালীন পাক্ষিক পত্রিকা মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত ‘হিতকরী’তে প্রকাশিত একটি রচনায় সর্বপ্রথম তাঁকে ‘মহাত্মা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। প্রতি বছর দোল পূর্ণিমা ও মৃত্যুবার্ষিকীতে ভক্তরা তাঁর মাজারে সাধুসেবা ও সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।