বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

কুষ্টিয়ায় লালন ভক্তরা গুরু ভক্তি ও বিদায়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি
কুষ্টিয়ায় লালন ভক্তরা গুরু ভক্তি ও বিদায়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি

লালনের গান বা দর্শন নিয়ে আলোচনা করলে মূলে দেখা যায় যে,সকল মানুষকেই গুরুর নিকট দীক্ষিত-আশ্রিত নিতে হবে।আর মুরীদ বা দিক্ষা নেওয়ায় কারনে মন নিয়ন্ত্রিত হয়- মন নিয়ন্ত্রিত হলে রাগ-হিংসা-বিদ্বেষ-কাম থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।লালন শাহের আদর্শ গ্রহণ ধারণ করা বেশ কয়েকজন ভক্ত জানান এটাই আমাদের মূলত লালন দর্শন। সংগীত সাধনার পাশে গুরুবাদী এই সাধক তাঁর ভক্তদের আত্মতত্ব ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিয়ে গেছেন।নেশা,কাম ও লেবাস ফেলে প্রকৃত মানুষ হতে একজন গুরু বা মুর্শিদ ধরার বিষয়ে শিক্ষা দিতে সংগীত সাধক লালন শাহ আমরণ কাজ করে গেছেন।

বৃহঃবার মরমী সাধক ফকির লালন সাঁই-এর ১২৮ তম তিরোধান (মৃত্যুবার্ষিকী) দিবসের তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা ও লালন মেলার সমাপণী ঘটছে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা লালন ভক্ত প্রেমিকেরা নিজ নিজ আসন ছেড়ে বিছানাপত্র গুছিয়ে রওনা হয়েছেন অনেকেই। তবে যাওয়ার আগে আঁখড়া বাড়ির পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে।গুরুকে বারবার প্রণাম ও নানা রকম ভক্তি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিদায় নেন ভক্তরা। গুরু ভক্তি আর সিদ্ধ মন নিয়ে বিদায় নেয়ার সময় অনেক ভক্তরা তাদের চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। পরম গুরুকে পেতে গত তিন দিন-তিন রাত ভক্তি আর শ্রদ্ধা দিয়ে ভক্তরা তাদের গুরু ভক্তি জানিয়েছেন। সংগীত সাধক ফকির লালন সাঁই-এর তিরোধান দিবসের অনুষ্ঠানমালা ও লালন মেলার শেষ দিনে বাউলরা বাড়ি ফেরার সময় একে অন্যকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে।

মরমী সাধক লালন শাহ তাঁর গানে বলেন, আগে কপাট মার কামের ঘরে, মানুষ ঝলক দিবে রুপ নিহারে। গুরুর দয়া যারে হয় সে-ই জানে, যেরূপে সাঁই বিরাজ করে দেহভুবনে। যে মুরশিদ সেই তো রাসূল ইহাতে নাই কোন ভুল খোদাও সে হয়, এ কথা লালন কয়না কোরআনে কয়। মানুষ ছেড়ে ক্ষেপা রে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি। সময় গেলে সাধন হবে না,দিন থাকতে দ্বীনের সাধন কেন জানলে না, তুমি কেন জানলে না,সময় গেলে সাধন হবে না।

এসকল গানসহ লালন শাহ আরো লিখেছেন সামাজিক ভেদনীতি, শ্রেণী-বৈষম্য, বর্ণ,শোষণ, জাতপাতের কলহ, সমস্ত-নিগ্রহ ও সাম্প্রদায়িক বিরোধের বিরুদ্ধে। দেখা গেছে ইতিহাসের ধারায় লালন শাহের নাম আজ দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ব জুড়ে।ভোগে নয়, ত্যাগেই ধর্ম। পার্থিব জীবনে চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। যারা গুরু মতবাদে বিশ্বাসী না, ফেতনা-ফ্যাসাদ করে, হৈ চৈ করতে আসেন তাদেরকে অন্তত লালন শাহের মাজারের ভেতরে আশ্রয় দেয়া ঠিক নয়।

জানা যায়, বৃটিশ শাসকগোষ্ঠির নির্মম অত্যাচারে গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনকে যখন বিষিয়ে তুলেছিল, ঠিক সেই সময়ই সত্যের পথ ধরে,মানুষ গুরুর দিক্ষা দিতেই সেদিন মানবতার পথ প্রদর্শক হিসাবে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের আবির্ভাব ঘটে কুমারখালির ছেঁউড়িয়াতে। লালনের জন্মস্থান নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকলেও আজো অজানায় রয়ে গেছে তাঁর জন্ম রহস্য। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। তবে তিনি ছিলেন স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত। যৌবনকালে পূর্ণ লাভের জন্য তীর্থ ভ্রমনে বেরিয়ে তার যৌবনের রূপামত্মর ও সাধন জীবনে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। তীর্থকালে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তার সঙ্গীরা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। পরে মলম শাহের আশ্রয়ে জীবন ফিরে পাওয়ার পর সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সান্নিধ্যে তিনি সাধক গুরুর আসনে অধিষ্টিত হন। প্রথমে তিনি কুমারখালির ছেঁউড়িয়া গ্রামের গভীর বনের একটি আমগাছের নীচে সাধনায় নিযুক্ত হন। পরে স্থানীয় কারিকর সম্প্রদায়ের সাহায্য লাভ করেন। লালন ভক্ত মলম শাহ আখড়া তৈরীর জন্য ষোল বিঘা জমি দান করেন। দানকৃত ওই জমিতে ১৮২৩ সালে লালন আখড়া গড়ে ওঠে।

প্রথমে সেখানে লালনের বসবাস ও সাধনার জন্য বড় খড়ের ঘর তৈরী করা হয়। সেই ঘরেই তাঁর সাধন-ভজন বসতো। ছেঁউড়িয়ার আঁখড়া স্থাপনের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিষ্যভক্তদের নিয়ে পরিবৃত থাকতেন। তিনি প্রায় এক হাজার গান রচনা করে গেছেন। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর ভোরে এই মরমী সাধক বাউল সম্রাট দেহত্যাগ করেন এবং তাঁর সাধন-ভজনের ঘরের মধ্যেই তাকে সমাহিত করা হয়।

লালন ভক্ত ও অনুসারিদের কথা মতে জানা যায়, সে সময় লালন শাহের আশ্রমে গুরু-শিষ্যে পরম্পরায় সাধু সঙ্গের মাধ্যমে মরমী ভাবের আদান প্রদান হতো। লালন শাহের মানবতাবাদী বাণী উপলব্ধি করে অনেকেই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন। লালন শাহের মতবাদটি একটি সম্পূর্ণ গুরুজনিত ধর্ম বিধায় সম্যক গুরুকে নিশানা করেই ভক্তদের সাধনা করতে হতো। গুরু শিষ্যের এই পাঠশালাকে সাধু- সঙ্গ নামে অভিহিত করা হতো। লালন দর্শন মতে প্রতিটি জীব মানুষেরই আত্মশুদ্ধি তথা আত্মার মুক্তি করতে হলে সাধু-সঙ্গের গুরুত্ব অত্যাধিক। গুরুর সঙ্গের নিয়মানুযায়ী সন্ধ্যায় দিন ডাকার মধ্যদিয়ে সাধু সঙ্গ শুরু হয়ে রাখাল সেবা,অধিবাসকালীন সেবা,বাল্য সেবা ও পূর্ণসেবা সহ নয় আলেক ধ্বনির মাধ্যমে সাধু-সঙ্গ শেষ হতো। এছাড়াও,গদি মান্য,আসনমান্য, আচলামান্য,সেবা দক্ষিণা দিতে হতো। সাধু সঙ্গ সমাপ্ত হবার পর অশ্রুসিক্ত নয়নে সাধু-গুরুরা বিদায় নিতেন। লালন দর্শন মতে জানাযায়,বদ্ধজীব মানুষ যখন গুরুর দিক্ষা নেই তখনই সে মানুষ। গুরুর ভক্তি ও খেদমতেই শিশ্যের কাছে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পহেলা কার্তিক তাঁর ভক্তরা গুরুর প্রতি চোখের জলের সুধা দিয়ে গভীর ভক্তি প্রদান করেন। তাঁদের মত,দৃশ্যমান গুরু খুশি হলে তবেই অদৃশ্যমান মহান সৃষ্টিকর্তা খুশি। মানুষ গুরুর দিক্ষা দিতেই গুরুর প্রতি ভাব বিনিময় করতে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন শাহের বাড়ীতে তাঁর ভক্তদের এই মিলন মেলা। সংগীত সাধক লালন শাহ তাঁর জীবদর্শায় প্রতি বছর দোল পূর্ণিমায় তাঁর অনুসারিদের সঙ্গে নিয়ে স্মরণোৎসব পালন করতেন। আর এখন বাংলা পহেলা কার্ত্তিক লালনের তিরোধান দিবস উপলক্ষে তাঁর শিষ্যভক্তগণ আরেকটি পালন করে থাকেন। আর এরই সাথে একাত্ব হয়ে জেলা প্রশাসন, লালন একাডেমি ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিবারের মত এবারও এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ৩ দিন ব্যাপী এ অনুষ্ঠানের প্রতিদিন যথারীতি থাকে আলোচনা সভা, মেলা ও নির্ধারিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন