অমূল্য নিধি সেই মহাসুখ যা অন্তরে পেয়ে পূর্ণ হতে চায় মানুষ, এক পরম জ্ঞান বা আদ্যশক্তি যার উন্মেষে ভাঙ্গে অচলায়তন, ভবকারাগার। অমুল্য নিধি অকৈতবও বটে। কারণ মিথ্যা ছলনা বা কপটতা এর লক্ষণ নয়। এই নিধি অটল, প্রাপ্তির আনন্দের পরও ফুরায় না। এই ধন সাঁই নিরঞ্জন।
কেমনে পাবো তারে, এই অনুসন্ধানই মানুষের নিরন্তর প্রেষণা। তাই আদিম পৌরাণিক যুগেও সর্বপ্রাণবাদের (Animism) মতো ধারনার জন্ম সম্ভব হয়, যেখানে মানুষ সর্বশক্তিমত্তাকে আপনকার আধ্যাত্মিক শক্তি বলেই জেনেছে, এবং প্রাণময় জগত-রূপেই ক্রিয়াশীল দেখেছে তাকে, অন্যত্র নয়। অথচ পরবর্তী ধর্মযুগে এই শক্তিকেই দেবতা ও ঈশ্বরে অর্পণের পর, আজকের বিজ্ঞান যুগে এসে, এই মানুষই হয়ে পড়লো আধ্যাত্মিক ক্ষমতাশূন্য এক মূঢ় জীব, নির্গুন জ্ঞানী। বিজ্ঞানের জগতে কোন অমুল্য নিধি নাই। কার্যকারণের কাঁচে তার দৃষ্টি বাঁধা, ঘোলাটে ও অসম্পূর্ন। বিশ্বজয়ী বিজ্ঞান মানুষের মন জয়ে তাই বরাবরই ব্যর্থ, কেননা সেই অকৈতব নিধির অবিরাম অন্বেষণ ছাড়া মানুষ-মনের গভীরতম প্রদেশে আর কোন ধিয়ান থাকতে পারে না।
কোথায় এই অধরার বাস? তাঁর রূপ কি স্বভাব কি প্রকৃতি কি- এসব জিজ্ঞাসার উত্তর জগত-প্রবাহে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে মানুষের ঈশ্বর হয় অদৃশ্য, নিরাকার- জগত হয় মায়া, পরকাল নিত্য হয়, সত্য হয়। যাবতীয় কর্মস্পৃহা ও জ্ঞান যেন জগত-মুক্তির আকাঙ্খায় অস্থির, এক অজানা অন্ধকার ঈশ্বরের দিকে ক্রমাগত ধেয়ে চলা।
ঠিক এমনি এক ধোঁয়াশা অবস্থার প্রেক্ষিত থেকে ফকির লালন খোঁজে আদিতত্ত্বের বেনা। আর কোথাও নয়, যা খুঁজছে মানুষ সেই অমুল্য নিধি পাওয়া যাবে কেবল বর্তমানেই, আর সবচে বড় বর্তমান হচ্ছে মানুষ- এই সময়ের মানুষ, জীবিত সহজ মানুষ।
সহজ মানুষ ভজে দেখনা দিব্য জ্ঞানে।।
পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে।।
ভজ মানুষের চরন দুটিনিত্যবস্তু রবে খাঁটি।
মরিলে সকলি মাটিত্বরায় এ ভেদ লও জেনে।।
তবে কি লালন ফকির শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর বিমুখ? না, কখনো তা নয়। সত্য এই যে তাঁর ঈশ্বর ভাবনা প্রাপ্তবস্তুর নিরিখে জিজ্ঞাসিত হয়ে ক্রমশ এক অবৈদিক পথকে নির্মান করে, যেখানে ঈশ্বর যতোটা না অলৌকিক তারচে অনেক বেশী লৌকিক। এই মর্মের গভীরে পৌঁছতে, যদি আমরা লালন ফকিরের সৃষ্টি-তত্ত্ব ও তার ঐতিহাসিক যোগসূত্রটি জানার চেষ্টা করি, তবে দেখব, সেখানে লালন সেমেটিক গুপ্ত আধ্যাত্মবাদ অন্বেষণ প্রয়াসী। জানামতে তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনের গুপ্ত সাধকেরা সব যুগেই ধর্মগ্রন্থের একটা ভিন্ন ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী ছিল, বিশেষত সৃষ্টি-তত্ত্বে এসে তারা ভীষণভাবে বেশরা। ইসলামের সুফিবাদেও এর ব্যাপক প্রভাব দেখা যায়।
কাব্বালাপন্থী ইহুদি গুপ্ত সাধকেরা বিশ্বাস করতো বা এখনও করে যে, পরম বা মূল ঈশ্বর এক অচেতন ‘না’ সত্তা। তিনি সৃজিত হন না, সৃজনও করেন না। তিনি নির্ভার নিষ্কাম। তাই এই ঈশ্বরের বাইরেও তারা সৃষ্টিসুখের আকাঙ্ক্ষায় ক্রিয়াশীল এক অভাবী ঈশ্বরের কল্পনা করেছিল যে মূল ঈশ্বর হতে ভিন্নও নয় অভিন্নও নয়। নাম তাঁর জেহভা- এ জগত তাঁরই সৃষ্টি। আদিতে অবশ্য ঈশ্বর ছিলেন এক এবং আর কিছুই ছিল না তখন সেই অনাদি ঈশ্বর ছাড়া। এইভাবে হয়ত অযূত লক্ষ কোটি বছর একাকী তিনি! তারপর একসময় কোন এক অকারণ কারণে যেন জেগে ওঠে দ্বিতীয়ের ইচ্ছা। তখন আপনকার অনুরূপ আরেকটি সত্তা-সৃষ্টি ব্যাতীত একাকী সেই ঈশ্বরের প্রকৃতপক্ষে আর কীবা উপায় থাকে। দ্বিতীয়ের আস্বাদ পেতে ঈশ্বর তাই নিজেকে সংকুচিত করতে করতে এমন এক স্তরে উপনীত হন যেখানে তাঁর মূল সত্তার স্বভাব স্থূলতায় লীন। এই জাগ্রত ঈশ্বরই জেহভা- মহান সৃষ্টিকর্তা।