বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

লালন দর্শনঃ অমূল্য নিধির বর্তমান ও নিহেতু প্রেম-সাধনা - শশী হক
লালন দর্শনঃ অমূল্য নিধির বর্তমান ও নিহেতু প্রেম-সাধনা - শশী হক

কাব্বালা-মতে জেহভা দশ অবতারী। প্রথম অবতার জেহভা হতে আবির্ভূত অনুরূপ আরেক অক্ষয় জ্যোতি স্বরূপ। প্রথমটি হতে এরপর একেএকে একইভাবে পূর্ন হয় পরবর্তী নয়টি অবতার। প্রত্যেক অবতার আবার তেমনি ত্রিশাখায় বিভক্ত। অবশেষে এই দশ অবতারে গঠিত হয় আদি মানব আদম কেডমন, যে স্বর্গবাসী আর আমরা তারই প্রতিনিধী। দশাবতারজাত আদম কেডমন হতে পুনরায় যে চারটি জগতের উদ্ভব, পার্থিব জগত তারই একটি। এই হলো রহস্যবাদী কাব্বালা সাধকদের সৃষ্টির গুপ্ত-কথা।

জেহভার মত লালন দর্শনেও আমরা অবতারী এক আল্লাহকে পাই নুরতাজেল্লা রূপে। এই নুরতাজেল্লাই সৃষ্টিকর্তা। অনির্বচনীয় অনিঃশেষ অতুল এক নুরের মহীমায় আল্লাহর কুদরতি প্রকাশ। এ যেন অব্যক্ত সুক্ষ স্তর থেকে আনন্দময় স্থুলে অবতরণ। এরপর দ্বিতীয়ের আকাঙ্ক্ষায় নুরতাজেল্লা থেকে নুর চুইয়ে উৎপন্ন হয় নবির নুর, নবিসত্তা, জগতসার। নবির অঙ্গ হতেই পয়দা হয় বায়ু অগ্নি জল ও মাটি- সরলে গরলে মেশা এই বিস্ময়কর বিশ্বজগত। লালন ফকিরের বিভিন্ন পদে এই ধারনারই সমর্থন পাই বারবার।

জানা উচিত বটেদুটি নুরের ভেদ বিচার।।
নবিজি আর নিরূপ খোদারনুর সে কি প্রকার।।
নবি যেন আকার ছিলতাহাতে নুর চোয়ায় বলো।
নিরাকারে কি প্রকারেনুর চোয়ায় খোদার।।
শুনি নবির অঙ্গে জগত পয়দা হয়।।
সেই যে আকার কি হল তারকে করে নির্নয়।।
আসমান জমিন জলধী পবন
যে নবির নুরে হয় সৃজন
বল কোথায় সে নবির আসন
পুরুষ কি প্রকৃতি আকার তখনে।।

লালন দর্শনে সৃষ্টির লতা মানুষ হতে শেষে আল্লায় গিয়ে মেশে। অথবা অনন্ত ধারা একের ভেতরেই বয়ে চলে। দুটোই সত্য, কারণ অই ‘এক’ কোন কিছু থেকেই বিযুক্ত নয়। এই ভাবনা থেকেই তাই আহাদ আর আহাম্মদ নামের প্রকাশ দেখি, সুফি আধ্যাত্মবাদ থেকে যার উদ্ভব। সৃষ্টির পূর্বে আহাম্মদি নুর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কাব্বালারা যাকে বলছে জেহভা তাই লালনে নুরতাজেল্লা, অন্য অর্থে আহাম্মদি নুর। সৃষ্টির বাসনায় আহাম্মদি নুর হতে আহাদ বিযুক্ত হয়ে গঠিত হয় নবি-সত্তা বা পরম প্রকৃতি। তারপর অবশিষ্ট ‘মীম’ হরফটি গোপন করে ‘আলিফ’ রূপে সৃষ্টির মূলে জাগ্রত হন ‘আলেক সাঁই’। কিন্তু তারপরেও মানব লীলার আস্বাদ পেতে সৃষ্টিকর্তা আহাদে ‘মীমকে’ যুক্ত করে তাঁর ‘আহাম্মাদ’ নামকে জানায়। এ কারনেই সাঁই নিরঞ্জনকে আমরা দেখি রাসুল মুহাম্মদে প্রকাশিত হয়ে মানবের কাণ্ডারি হতে, জাহের বাতেন এই দুইভাব উপাসনার মুলসাধনা জানাতে যা আর কখনো কেউ করেনি। অন্য কিছুতে না ভুলে তাই রাসুলের এই দ্বীনকেই সত্য মানতে বলছে লালন।

আহাদে আহাম্মাদ হলো
মানুষে সাঁই জন্ম নিলো।
লালন মহাগোলে পড়লো
সাঁই-এর লীলার অন্ত নাহি পায়।।
আহাদে আহাম্মাদ এসে
নবি নামটি জানাইলে।
যে তনে করিলে সৃষ্টি
সেই তন কোথায় রাখিলে।।

…..আহাদ নামে কেন রে ভাই
মানব লীলা করলেন গো সাঁই।
লালন বলে তবে কেন যাই
অদেখা ভাবুক দলে।।

সৃষ্টির গভীরে যেতে জানা উচিৎ বটে বীজ-বৃক্ষ তত্ত্ব। সৃষ্টির পূর্বে নুরতাজেল্লা বা আহাম্মদি নুর যে আদ্য-শক্তিতে ভাস্বর তা এক পরম বীজশক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়, নিগুম্ব ধ্বনি থেকে যার উদ্ভব। প্রকাশে আকারে এই বীজ-শক্তিই বৃক্ষ আর সেই বৃক্ষই নবি- বীজ থেকে ভিন্নও নয় অভিন্নও নয়। এই বৃক্ষসত্তাময় নবি-অঙ্গ হতেই জগতের উৎপত্তি আর বীজবৃক্ষের মিলনের মধ্য দিয়েই নিরন্তর এগিয়ে চলছে ব্রহ্মাণ্ড। লালনমতে বীজকে জানতে হলে বৃক্ষকেই জানতে হয় আগে, জানতে হয় তার মূল কাণ্ড পত্র ও পুস্পকে। তেমনি প্রকৃতি-রূপ নবিকে জানলেই পুরুষ-রূপ সাঁইকে জানা সম্ভব হয়।

মন কি ইহাই ভাবো আল্লাহ পাবো
নবি না চিনে।।

কারে বলিশ নবি নবি
দিশে পালিনে।।

বীজ মালেক-সাঁই বৃক্ষ নবি
দিল ঢুঁড়িলে জানতে পাবি।
কি কবো সেই বৃক্ষের খুবি
তার এক ডালে দ্বীন
আরেক ডালে দুনে।।
বোঝা কঠিন কুদরতি খেয়াল
নবিজি গাছ সাঁইজী তার ফল।
যদি সেই ফল পাড়ো অই গাছে চড়ো
লালন কয় কাতর ভাবে।।

সর্বগুনধাম আল্লার নিরানব্বইটি নামের মধ্যে দুটি নাম হচ্ছে ‘আল যাহির’ (প্রকাশিত) এবং ‘আলবাতেন’ (অপ্রকাশ্য)। অদৃশ্য নৈরাকার আল্লার কথা যদিও লালন কখনো অস্বীকার করেনা কিন্তু তাঁর সকল ধিয়ান, অনুসন্ধান শুধুমাত্র ওই প্রকাশ্য আল্লাকেই পাবার জন্য। অদৃশ্যের সাধনা তাঁর কাছে আঁধার ঘরে সর্প ধরার সমান। ওই পথ ফকিরের নয়, সে দৃশ্যমান বর্তমানের ভেতরেই শুধু নিরঞ্জনকে খোঁজে।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.