চারণ কবি জারী সম্রাট মোসলেম উদ্দিন বয়াতী (জন্মঃ- ১৯০৪ - মৃত্যুঃ- ১৯ আগস্ট ১৯৯০) বাল্যকাল হতেই তিনি সংগীতানুরাগী ছিলেন এবং জারী, ভাব, মুর্শিদী ও পয়ার ইত্যাদি গান গাইতেন। তৎকালের বিখ্যাত সব গায়কের সাথে তিনি গানের পাল্লা দিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর গান শুনে প্রায় সকল দর্শকই কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেন।
প্রখ্যাত জারী গান রচয়িতা, গায়ক ও সুরকার মোসলেম উদ্দীন ১৯০৪ সালে নড়াইল জেলার তারাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আব্দুল ওয়াহেদ মোল্যা এবং মাতার নাম সাখাতুন্নেছা।
১৯২৬ সালে নড়াইল জেলার কালিয়া থানার গোলচেহারা বিবির সাথে মোসলেম উদ্দীন বয়াতি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৫০ সালে তিন পুত্র রেখে স্ত্রী গোলচেহারা বিবি মারা গেলে ১৯৫৭ সালে কালিয়া নিবাসী রূপজান বিবিকে তিনি দ্বিতীয় বারের মত বিবাহ করেন। ১৯৬৮ সালে দ্বিতীয় স্ত্রী সন্তান প্রসবকালে দুই পুত্র ও এক কন্যা রেখে মুত্যুবরণ করলে মেসলেম উদ্দীন আমিনা খাতুনকে তৃতীয় বারের মত বিবাহ করেন। আমিনা খাতুনের গর্ভে দুই পুত্র ও দুই কন্যা জন্মগ্রহণ করে।
শিশুকালে স্বল্প শিক্ষিত পিতা আব্দুল ওয়াহেদ মোল্যার কাছেই তাঁর বিদ্যাশিক্ষার সূচনা। আনুষ্ঠানিক শিক্ষারাম্ভ হয় সোলপুর নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর তিনি ভর্তি হন নিজ গ্রামের উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। চাচুড়িয়া-পুরুলিয়া মধ্য ইংরেজী স্কুলেও তিনি কিছুদিন পড়াশুনা করেন। সিঙ্গিয়া সোলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন আকস্মিকভাবে তাঁর পিতার মৃত্যু ঘটায় এখানেই তাঁর শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
শৈশবকাল থেকেই মোসলেমের সঙ্গীতের প্রতি প্রবল অনুরাগ ছিল। গ্রামের মাঠে-ঘাটে একাকী গান গেয়ে বেড়াতেন তিনি। গ্রামের আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়ানো, ভাসান গান, ভাব গান, কীর্তন ও জারী সারীর সুরের দোলায় দুলে উঠতো তাঁর মন।
পিতৃহীন অনাথ মোসলেমকে অল্প বয়স থেকেই পালন করতে হয় সংসারের গুরু দায়িত্ব। এরই ফাঁকে তিনি সুযোগ করে নিতেন গান শেখার। তাঁর সঙ্গীতে প্রথম হাতেখড়ি কালিয়া থানা অন্তর্গত হাতিয়ার ঘোপের ফকির মোকতার বিশ্বাসের কাছে এবং পরবর্তী সময়ে শাহ্ সুফি পরশ উল্লাহর নিকটেও তিনি ভাব গানের দীক্ষা গ্রহণ করেন।
খুলনার ফুলতলায় তামাক ব্যবসায়ীর দোকানে হিসেবের খাতা লেখার কাজ করার সময় দামোদর গ্রামের সুখলাল বাবুর স্ত্রী নন্দিনী দেবীর মর্মান্তিক হত্যাকান্ডকে ঘিরে তিনি রচনা করেন এক বিরহ বিধুর ধূঁয়া কাব্যগীতি। তাঁর লেখা প্রথম ধূঁয়া কাব্য গীতিটি তৎকালীন সময়ে অতি জনপ্রিয় হয়েছিল। এরপর তাঁকে আর থেমে থাকতে হয়নি। একের পর এক রচনা করেছেন জারী ও ভাব গান। সুরেলা মিষ্টি কণ্ঠের অধিকারী মোসলেম উদ্দীন গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন আসরে গান শুনিয়ে ব্যাপক সুনাম অর্জন করতে লাগলেন। অবশেষে তিনি ১৯৩৬ সালে জারি গানের নিজস্ব দল গঠন করেন।
জারিগান ও কবিগানে নড়াইলের শ্রেষ্ঠ দুই ব্যক্তি জারিয়াল মোসলেম বয়াতি ও কবিয়াল বিজয় সরকারের একই মঞ্চে গান শোনার জন্যে লক্ষ শ্রোতার সমাগম আজও মানুষের মনে ছবির মত উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় অনুষ্ঠিত সঙ্গীত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে এবং বিভিন্ন গায়কদের সাথে জারি ও কবিগানের পাল্লা দিয়ে তিনি ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। জারিয়াল মোসলেম উদ্দীন যেসব জারিয়াল ও কবিয়ালদের সাথে পাল্লায় গান করেছেন তাঁদের মধ্যে নড়াইলের বিজয় সরকার, কিবরিয়া বয়াতি, রসিকলাল সরকার, খুলনার তোরাব বয়াতি, অনাদি সরকার, ফরিদপুরের নিশিকান্ত সরকার, নারায়ণ সরকার, বরিশালের গনি বয়াতি উল্লেখযোগ্য।
কবিগান ও জারিগান মূলত লোকসঙ্গীতের অংশবিশেষ হলেও পরিবেশন ও রচনাভঙ্গির দিক থেকে এ জাতীয় গানের মধ্যে গভীর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। জারিগানের ধারক ও বাহক মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন এবং কবিগানের ধারাটি হিন্দু সম্প্রদায়ের হাতেই লালিত-পালিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে এদেশের হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের শ্রোতাকুল কবি ও জারিগানকে সমান আদরে হৃদয়ে লালন করেন। এই জনপ্রিয় খ্যাতিমান জারি গায়ক কবিয়াল মোসলেম বয়াতি ভাবসঙ্গীতের ভাবরসে তন্ময় হয়ে বেঁধেছেন অনেক অনেক কালজয়ী গান। লক্ষ শ্রোতামোদীর হৃদয়ে তাঁর সুমিষ্ট কণ্ঠের প্রতিধ্বনি আজও অনুরণিত হয়। মোসলেম উদ্দীন রচিত, সুরারোপিত এবং পরিবেশিত একটি চিরকালের গান- লক্ষ শ্রোতামোদীর হৃদয়ে তাঁর সুমিষ্ট কণ্ঠের প্রতিধ্বনি আজও অনুরণিত হয়। মোসলেম উদ্দীন রচিত, সুরারোপিত এবং পরিবেশিত একটি চিরকালের গানের অংশ বিশেষ:
নিশি প্রভাতকালে কোকিল বলে ওরে সখিনা
এ বেশে আর ঘুমিয়ে থেকোনা।
মাঝে দরিয়ায় ডুবলোরে তোর লাল ডিঙ্গিখান,
তখন জাগিয়ে দেখে, বিছানার উপর খসে পড়েছে
নাকের সোনা,
গলার হার পড়েছে খসে বিধির কারখানা
দেখে শিরে আঘাত মেরে বলে
বিধিরে তোর কি এই বিবেচনা।
এই সুরশিল্পী মোসলেম উদ্দীন বয়াতী ১৯৯০ সালের ১৯ আগস্ট মুত্যুবরণ করেন।