বাউল মতবাদকে একটি মানস পুরাণ বলা হয়। দেহের আধারে যে চেতনা বিরাজ করছে, সে-ই আত্মা। এই আত্মার খোঁজ বা সন্ধানই হচ্ছে বাউল মতবাদের প্রধান লক্ষ্য। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একে পৃথক দর্শন বুঝায়। কিন্তু আসলে এ কোন পৃথক মতবাদ নয়।
এটি ধর্মীয় দর্শন থেকে সৃষ্ট আত্ম চিন্তার রুপভেদ। যা মুলতঃ আত্মার অধ্যাত্ম চেতনার বহিপ্রকাশ। বাংলাদেশের লোক সাহিত্য ও লোকঐতিহ্য, লালন শাহ বিবেচনা-পূর্নবিবেচনা প্রভৃতি গ্রন্থে গবেষকগণ লিখেছেন; আরবের রাজ শক্তির প্রতিঘাতে জন্ম হয়েছে সুফি মতবাদের । এটিকে লালন-পালন করেছে পারস্য। বিকাশ ইরান ও মধ্য এশিয়ায়। পরবর্তিতে যতই পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে থাকে এর মধ্যে ততই পূর্বদেশীয় ভাবধারার সম্মিলন ঘটতে থাকে। দহ্মিণ এশিয়ায় এসে অধ্যাত্ম সঙ্গীত চর্যাগীতিতে রুপান্তর হয়। অতপর তুর্কী বিজয়ের মধ্যদিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সূফী-দরবেশ গণের আগমনে বৌদ্ধ সিদ্ধাচর্যাগণের আদর্শ মানবতাবাদ, সুফীবাদে সম্মিলিত হয়ে ভাবসঙ্গীতে রুপান্তর হয়। ফলে সুফী দর্শন অতি সহজে বৌদ্ধের কাছের প্রশংসনীয় হয়।
কাজেই একদিকে সূফীবাদ এবং অন্যদিকে বৌদ্ধ সাধনা এই সকলের সমম্বয়ে গড়ে উঠে মরমী ভাব-সাধনা। গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামাল, ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী সহ অনেকে এ অভিমত পোষন করেন; মধ্যযুগের প্রারম্ভে বাংলার শ্যামল জমিনে অদৈত্ববাদের মধ্যদিয়ে ভারতে চৈতন্যবাদ বিকশিত হয় পঞ্চদশ শতাব্দিতে। তখন ভাগবতধর্ম, আদি রামধর্ম ও কৃষ্ণধর্মের মিলনে বৈঞ্চবধর্ম আত্মপ্রকাশ করে। এতে করে বৈঞ্চবী সাধন পদ্ধতির মধ্যে অনিবার্য রূপে শামিল হয় প্রাচীন মরমীবাদ।
ফলে পূর্বরাগ, অনুরাগ, বংশী, বিরহ, দেহকাঁচা ও সোয়া-ময়না সম্মেলিত ইত্যাদি মরমী সাহিত্যের শব্দ, নামে উপনামে বৈঞ্চববাদে বা বৈঞ্চব সাহিত্যে সরাসরি ধার করা হয়। এ ভাবে মরমীবাদের হূদয়স্পর্সী শব্দমালায় রচিত সঙ্গীত বাউল সঙ্গীত নামে আত্মপ্রকাশ করে এক নতুন সম্প্রদায়ের জন্ম দেয়, যা আজকাল বাউল নামে অভিহিত। 'বাহুল' বা 'ব্যাকুল' থেকে 'বাউল' নিষ্পন্ন হতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন।
আবার আরবি 'আউল' বা হিন্দি 'বাউর' থেকেও শব্দটি আসতে পারে। যেভাবে যে অর্থই আভিধানিক হোক না কেন, মূলত এর ভাব অর্থ হলো, স্রষ্টা প্রেমিক, স্বাধীন চিত্ত, জাতি সম্প্রদায়ের চিহ্নহীন এক দল সত্য সাধক, ভবঘুরে। বাউলদের মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে বাউল সঙ্গীত নামে পরিচিত আধ্যাত্মচেতনার গান। এ বিষয়ে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলেছেন : ইদানিং বাউল শব্দের উৎপত্তি নিয়ে নানা বাক-বিতন্ডার সৃষ্টি হয়েছে। কেউ বা একে সংস্কৃত ‘বতুল' (উন্মাদ, পাগল, ক্ষেপা, ছন্নছাড়া, উদাসী) শব্দের অপভ্রংশ বলে মনে করেন। তবে যা থেকেই বাউল শব্দের উৎপত্তি হোক না কেন, বর্তমানে বাউল মতবাদ একটি বিশেষ মতবাদে পরিণত হয়েছে।
উৎপত্তিকাল
বাউল ও বাউলা মতবাদের উৎপত্তিকাল আনুমানিক ১৬৫০ খৃস্টাব্দ। ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান' গ্রন্থে প্রফেসর উপেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য এ অভিমত পোষণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করেন, বৌদ্ধদের মহাযান পন্থী থেকে বাউলদের উদ্ভব। বাউলদের রয়েছে নানাবিধ শাখা-প্রশাখা।
আনুমানিক ১৪৫০ খ্রিস্টাবেদ হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার বাঘাসুরা গ্রামে জগমোহন গোসাঈর জন্ম হয়। তার পিতার নাম সুধবানন্দ, মাতার নাম কমলা। তিনি জগন্মোহিনী বাউল সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। তাকে আদি বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক হিসেবেও গণ্য করা হয়। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার মাছুলিয়া গ্রামে তার আখড়া বিদ্যমান। মাছুলিয়ার বিজনবনে বসে তিনি ধ্যান করতেন বলে জানা যায়।তার শ্যাম ও সুদাম নামে দুইজন পুত্র সন্তান ছিল।তারা তাদের পিতার কথা জানতে ফেরে মাছুলিয়ার বিজনবনে তপস্যারত জগন্মোহনের নিকট উপস্হিত হন। পিতা,পুত্রের এই করুন কান্নার ধ্বনি জগন্মোহন গোসাইর প্রথম শিষ্য গোবিন্দ গোসাই তাহা অবলোকন করেন।
অবশেষে জগন্মোহন গোসাঁইর আদেশে,তার প্রথম শিষ্য গোবিন্দ গোসাই,তাহাদের শিষ্য করিয়া নিল।জগন্মোহনের শিষ্য,গোবিন্দ গোসাঁই,গোবিন্দের শিষ্য শ্যাম বাউল গোসাঁই,শ্যামবাউলের শিষ্য রামকৃষ্ণ গোসাঁই। জগন্মোহিনী সম্প্রদায়ের জপতপের মূলমন্ত্র ‘গুরু সত্য'। জগমোহন গোসাইর এক প্রশিষ্যের নাম রামকৃষ্ণ গোসাঈ। বানিয়াচং উপজেলার বিথঙ্গলে তার প্রধান আখড়া রয়েছে। এ আখড়ার অধীনে প্রায় চারশ' ছোট বড় শাখা আখড়াও আছে। হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে এ সম্প্রদায়ের অনেক বাউল-বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী ছিল ও আছে। রামকৃষ্ণ গোসাঈর বারো জন শিষ্যের নামে বারোটি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকার ফরিদাবাদেও এ সম্প্রদায়ের একটি বড় আখড়া আছে।
বাউলদের বিশ্বাস
বাউলদের আদি জগন্মোহিনী সম্প্রদায়ের জপতপের মূলমন্ত্র ‘গুরু সত্য'। এরা পরলোকগত গুরুর পাদুকা বা জুতাকে সযত্নে সংরক্ষণ করে ভক্তি শ্রদ্ধা করে। বিবাহ-শাদীও হয় তাদের নিজস্ব তরিকায়। এরা কোন ধরনের জাতপাতের ধার ধারে না। এদের মধ্যে ছোয়াছুইরও কোন বালাই নেই। এ সম্প্রদায়ের বাউলরা তিন ভাগে বিভক্ত। গৃহী, সংযোগী ও উদাসী। এটি বেশ প্রাচীন ধারা। তারা মনে করেন, এই এক জীবনে স্রষ্টার ভালোবাসা পাওয়া যথেষ্ঠ, তবে সে ভালোবাসা খুব সহজে পাওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য প্রচুর সাধনা করতে হবে।
পরবর্তীকালে (আনুমাণিকঃ ১৯ শতকের শুরু থেকে) এদের প্রভাব এক শ্রেণীর মুসলমান বাউলদের মাঝে আছর করে। ফলে বাউল কবি মুসলমান হলেও এরা ইসলামী শরীয়তের হুকুম আহকামের ধার ধারে না। এসব ফকীরের দল বিভিন্ন সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ে বিভক্ত। যথা- আউল, বাউল কর্তাভজা, সহজিয়া প্রভৃতি। এরা বিভিন্ন ধরনের বাক-ভঙ্গি ও মুখরুচক বাক্য দ্বারা সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে।
(বাড়তি পঠনঃ- প্রবন্ধ-বৈষ্ণব তীর্থ-বিথঙ্গল আখড়া দর্শনে : নিকুঞ্জ বিহারী গোস্বামী। সিলেট কথা : কৃষ্ণ কুমার পাল চৌধুরী। বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস : আববাস আলী খান, পৃষ্ঠা-৬৬, ষষ্ঠ প্রকাশ । সিলেট নগর ও বিভাগ পরিক্রমা : প্রবন্ধ-শেকড়ের সন্ধানে অভিযাত্রা-হাছন রাজার বাড়ি : সৈয়দ মোস্তফা কামাল।)