৮ই ডিসেম্বর ঐতিহাসিক কুষ্টিয়ার মিরপুর, ভেড়ামারা ও দৌলতপুর থানা পাকিস্তানী হানাদারমুক্ত হয়। বাঙ্গালী ও বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের ৮ই ডিসেম্বর বহু ত্যাগ-তিতীক্ষার বিনিময়ে কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর থানার পাকিস্তানী হানাদারমুক্ত দিবস হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়।
১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি আফতাব উদ্দিন খাঁনের নের্তৃত্বে শতাধিক মুক্তিকামী ছাত্র-জননেতা বর্তমান কলেজ রোডস্থ পোষ্ট অফিস সংলগ্ন মসজিদে শপথ গ্রহণ করেন।
৩০ মার্চ শেষ রাতে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনে প্রতিরোধ যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর জেলা স্কুলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমন শুরু হলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে যশোর সেনানিবাসের সাহায্য চায়। কিন্তু সেখান থেকে কোন সাহায্য না পাঠানোর সংকেত দিলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী রাতের অন্ধকারে তিনটি গাড়ীতে করে গুলি বর্ষন করতে করতে যশোর সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যায়।
এসময় পাক সৈন্যরা ২টি গাড়ী ঝিনাইদহ জেলার গাড়াগঞ্জের কাছে রাস্তা কেটে তৈরী মুক্তিবাহিনীর ফাঁদে পড়ে গেলে গাড়ির সেনারা ঐ এলাকার ক্ষিপ্ত মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়। পাকিস্তানী বাহিনীর অপর ৬ সদস্য ভোরে জিলা স্কুল থেকে মিরপুরের দিকে পালিয়ে আসতে থাকে। প্রথম তারা মশান বাজার মাঠের মধ্যে তীব্র প্রতিরোধের মধ্যে পড়ে কিন্তু পাক সৈন্যদের গুলিতে মশানের ডা. আব্দুর রশিদ, হিলম্যান, গোপাল শেখ, আশরাফ আলী ও সোনাউল্লাহ শহীদ হন।
মিরপুর থানার কামারপাড়ায় বিছিন্ন ৩ পাকিস্তানী হানাদারের সাথে স্থানীয় মুক্তিকামীদের আবারও যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মিরপুর থানার সিপাহী মহিউদ্দিন শহীদ হন। অপর পক্ষে পাকিস্তানী বাহিনীর ঐ ৩ সদস্যও নিহত হয়।
উল্লেখ্য, শহীদ সিপাহী মহিউদ্দিনের কবরের পাশে মিরপুর উপজেলার শহীদ স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানী বাহিনী পুনরায় বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে শুরু করে। মিরপুর থানার তৎকালীন থানা কাউন্সিল ভবন এলাকায় (বর্তমান উপজেলা পরিষদ চত্বর এলাকা) পাকিস্তানী বাহিনী একটি শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে। এখানে ২শ ৫০ জনের পাকিস্তানী মিলিশিয়া বাহিনী ভারী অস্ত্র সজ্জিত অবস্থায় অবস্থান গ্রহণ করে। পাকিস্তানী বাহিনী আমলা ডিগ্রী কলেজেও একটি ঘাঁটি স্থাপন করে।
পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসররা আবারও সংগঠিত হওয়ায় নারী-পুরুষ, শিশু আবাল, বৃদ্ধ-বণিতাসহ হাজার মানুষ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে শুরু করে।
১৬ এপ্রিল ভারতের করিমপুরে ইয়্যুথ ক্যাম্প উদ্ধোধন করা হয়। এই ক্যাম্পে মুক্তিকামী জনতা মুক্তিযোদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ ও উচ্চ প্রশিক্ষনের জন্য অবস্থান করতে থাকেন। এ ক্যাম্প স্থাপনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন তৎকালীন মিরপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আব্দুল জলিল, মরহুম আব্দুল ওয়াহেদ, জলিল আহম্মেদ খুকু, আনোয়ার ভাষানী, গোলাম কিবরিয়া, আফতাব উদ্দিন খাঁন, রাহান আলী, কুববাত আলী, বিল্লাল হোসেন প্রমুখ।
ক্যাম্পটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন তৎকালীন এমপি (পরে এমসিএ), দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের জোনাল কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সাবেক এমপি প্রয়াত আব্দুর রউফ চৌধুরী (এমসিএ) ও গোলাম কিবরিয়া (এমসিএ)।
উক্ত ক্যাম্প থেকে ভারতের জামসেদপুর ক্যাম্পে রিক্রুট করার পর উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য বিহার প্রদেশের সিংভুম জেলার চাকুলিয়াতে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানো হতো।
চাকুলিয়া উচ্চ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বর্তমান মিরপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধো কমান্ডের আহবায়ক আফতাব উদ্দিন খাঁন প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উচ্চ প্রশিক্ষণ শেষে ভারতের শিকারপুর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাকশন ক্যাম্প থেকে ই-৯এর গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে তিনি বাংলাদেশের অভ্যান্তরে প্রবেশ করেন।
২৬ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলাধীন শেরপুর গ্রামে কুষ্টিয়া জেলা সর্ব বৃহৎ গেরিলা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এযুদ্ধে নের্তৃত্ব দেন কমান্ডার আফতাব উদ্দিন খাঁন ও সহকারী কমান্ডার জলিলুর রহমান।
২৫ নভেম্বর রাতে কমান্ডার আফতাব উদ্দিন খাঁন প্রায় ১শত জন সুসজ্জিত মুক্তিবাহিনীর একটি দল নিয়ে সেনপাড়ায় অবস্থান করেন। বিষয়টি পাকিস্তানী বাহিনী আঁচ করতে পেরে মধ্য রাতে শেরপুরে আগুন ধরিয়ে বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষন শুরু করে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী বাহিনী অবস্থান জানতে পেরে মিরপুর ও দৌলতপুর থানার মধ্যবর্তী স্থান সাগরখালী নদীর তীরে তাদের অবস্থান তড়িৎ সুদৃঢ় করে। রাত ৩ টায় তারা পাকবাহিনীর মোকাবেলার জন্য ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হতে থাকে।
২৬ নভেম্বর ভোর ৫টায় উভয় পক্ষ পরষ্পর মুখোমুখি হয়ে ৬ ঘন্টাব্যাপী তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানী বাহিনী পিছু হইতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে ৬০ জন পাকসৈন্য নিহত এবং শেরপুরের হাবিবুর রহমান নামে এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
এছাড়াও একই গ্রামের হিরা ও আজিজুল গুরুতর আহত এবং কমান্ডার আফতাব উদ্দিন খান সহ আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
মুজিব বাহিনীর কমান্ডার নাজমুল করিম সুফি গ্রুপ কমান্ডার হাবিবুর রহমান ইদ্রিস আলীর সহযোগিতায় পাহাড়পুর পুরাতন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালি ক্যাম্প স্থাপন করেন। কুষ্টিয়া সাব-সেক্টর কমান্ডার তৎকালীন লে. খন্দকার নুরুন্নবী ওই ক্যাম্প সরজমিনে পরিদর্শন করে অনুমোদন প্রদান করেন।
৭ ডিসেম্বর ভোরে পাহাড়পুর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প থেকে অভিযান চালিয়ে আমলা এলাকা পাক হানাদার মুক্ত করা হয়। ঐদিন রাতে মুক্তিবাহিনী সুলতানপুর গ্রামে মৃত আবুল হোসেন জোয়ার্দারের বাড়ি সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান থেকে পাকিস্তানী বাহিনী শক্তিশালী ঘাটিটি অতি সন্নিকটে ছিল শেরপুর যুদ্ধের পরে এলাকায় প্রচার ছিল সংশ্লিষ্ট এলাকায় এক হাজার মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছে। পাকিস্তানী বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সুলতানপুর গ্রামে অবস্থানের বিষয়টি জানতে পেরে রাতের আধারে পালিয়ে যেতে থাকে। পালিয়ে যাওয়ার সময় মিরপুর থানার (পুলিশ ফাঁড়ি) সমস্ত কাগজপত্র পুড়িয়ে দেয়।
৮ ডিসেম্বর ভোরে কমান্ডার আফতাব উদ্দিন খান ১৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মিরপুর থানায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা গান স্যালুটের মাধ্যমে উত্তলোন করেন। এরপর ৬৫ জন পাক হানাদার বাহিনীর দোসর ও রাজাকার পাহাড়পুর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আত্মসমর্পন করে।
মিরপুর হানাদার মুক্ত হওয়ার সংবাদ এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে ১৯৭১ সালের এদিনে বিভিন্ন বয়সের হাজার হাজার নারী-পুরুষ রাস্তায় নেমে আনন্দ উল্লাস করতে থাকে।
একই দিন ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে মিত্র বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা কুষ্টিয়ার ভেড়ামারাকে শত্রুমুক্ত করে। এই দিন ৮নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুরের নেতৃত্বে জেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা রাশেদুল আলম’র নেতৃত্বে ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে ভোর ৭টার সময় ভেড়ামারা ফারাকপুরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রায় ৭ ঘন্টা ব্যাপী এই যুদ্ধে ৮ জন পাক সেনা নিহত হয়। যুদ্ধের পর পরই মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রায় ৫০/৬০ জন রাজাকার নিহত হয়। এই ঘটনার সংবাদ পেয়ে ভেড়ামারায় অবস্থানরত পাকিস্তানী বাহিনীর অন্যান্য সদস্যদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। তারা সন্ধ্যার আগেই ভেড়ামারা থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ দিয়ে পালিয়ে ঈশ্বরদীর দিকে পালিয়ে যায়। এই দিন রাতে মুক্তিপাগল মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে ভেড়ামারায় প্রবেশ করতে থাকে। তারা বিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠে।
এদিকে, ৮ ডিসেম্বর সকালে আল্লার দরগায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী দৌলতপুর ত্যাগ করার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে গুলি বর্ষন করলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক। এরপর দৌলতপুর হানাদার মুক্ত ঘোষনা করেন তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা সাবসেক্টর কমান্ডার মেজর নুরুন্নবী। এভাবে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রামের ৮ডিসেম্বর কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানাও হানাদার মুক্ত হয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে দৌলতপুরকে শত্রু মুক্ত করে থানা চত্বরে বিজয় পতাকা উড়ানোর মধ্য দিয়ে মুক্তিকামী বীর সূর্য সন্তানেরা তাদের বিজয় বার্তা ঘোষণা করেন।
মিরপুর, ভেড়ামারা ও দৌলতপুরকে হানাদার মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সন্মুখ যুদ্ধসহ ছোট-বড় ১৬টি যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। এসকল যুদ্ধে ৩৫জন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ কয়েক’শ নারী-পুরুষ শহীদ হন। সবচেয়ে বড় যুদ্ধ সংঘঠিত হয় উপজেলার ধর্মদহ ব্যাংগাড়ী মাঠে। এ যুদ্ধে প্রায় সাড়ে ৩’শ পাকসেনা নিহত হয়। শহীদ হন ৩জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ৩জন ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সদস্য।