বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

কুষ্টিয়ার আদি ইতিহাস
কুষ্টিয়ার আদি ইতিহাস

আজকের কুষ্টিয়ার ইতিহাস খুঁজতে গেলে গড়াই নদীর উত্তরপশ্চিম পাড়ে মিরপুর থানার তালবাড়িয়ার মুখে পদ্মার কাছে সেকালের স্টিমার ঘাটে যেতে হবে। নদীর পাড়ের গ্রামটির নাম পুরাতন কুষ্টিয়া। ১৭৬০ সালে বাংলার নবাব মীর কাসিম তারও বেশ আগের নবাব মুর্শিদকুলি খানের, চাকলাপ্রথা তুলে দিয়ে জেলাপ্রথা চালু করেন। ১৭৭৮ সালে বাংলার ২৮ জেলার মধ্যে একটির নাম ছিল মহম্মদশাহী। আমাদের কুষ্টিয়া ছিল সেই জেলারই সামিল।

তারপর থেকে ঐ জেলাপ্রথায় ঈঙ্গতুর্কি ঐতিহ্যের একটি সমন্বিত প্রশাসন গড়ে উঠেছিল। ১৭৭৬ সালে বাংলায় যে ২৮ জেলা ২৬ থানা এবং ২৪ ফাঁড়ি ছিল, পরবর্তীকালে ১৭৮৬ সালে সামিল হয়ে গেল যশহোর জেলার সাথে। তখন তার থানাগুলো হলো কুষ্টিয়া, ধরমপুর, নওপাড়া, ভাদালিয়া, ভালুকা, খােকসা এবং কুমারখালী। ১৮২৮-৫৮ পর্বে পাবনা জেলাধীন কুষ্টিয়া থানার দেওয়ানি কাজকর্ম হতাে পাবনা আদালতে, ফৌজদারি কাজকর্ম হতাে যশাের কালেক্টরটের আদালতে। কুষ্টিয়ার ইতিহাসের তথ্য উপাত্ত যা পাওয়া যায়, তা সামান্য, খুবই অল্প পরিসরে, আসল কুষ্টিয়া অর্থাৎ পুরাতন কুষ্টিয়ার ইতিহাসের খবর অল্পই। নদীয়ারাজ বা আকবরি আমলে তার অস্তিত্বের কথা কেউ কেউ বলেন, তাও অপ্রমাণিত। কুষ্টিয়া। (১৮৫৯ সনের) যখন নদীয়া জেলাধীন তখনকার কথা। নীলহাঙ্গামা, পদ্মানদীর ভাঙ্গন এবং ইংরেজ শাসন সম্প্রসারণের স্বার্থে গড়াই নদীর পূর্ব-দক্ষিণ পাড়ে মজমপুর গ্রামের ওপর কুষ্টিয়া থানা গড়ে ওঠে। বাংলার ছােটো লাট কুষ্টিয়াকে মহকুমার ঘােষণা দেন ১৮৬০ সালে। আবার ঐ সময়ের প্রাকৃতিক দিকদিয়ে বিবেচনায় দেখা যায় আজকের রেনউইকের পাশ দিয়ে ছােটো খাল আকারে বের হয়ে গড়াইয়ের শাখা জিলা স্কুলের উত্তরপূর্ব কোণ দিয়ে বর্তমান ডিটাইপ বিলিডংএর পাশ দিয়ে বয়ে যেয়ে হাউজের ওপর দিয়ে চাপাইগাছি বিলের সাথে সংযােগ ঘটে। তবে ১৮৬৩ সালে গােটাদশেক গ্রাম নিয়ে আজকের কুষ্টিয়া মহাকুমাশহর গড়ে ওঠে।

তখনকার কুষ্টিয়া থানার এবং তারও পরে যশাের জেলার খােকসা থানার এবং আরও পরে কুমারখালী থানার শালঘরমধুয়া গ্রামের নীলকুঠি তৈরি করেন টমাস কেনি, নীল ব্যবসার লক্ষ্যে বর্তমান থানাপাড়ার পাঁচরাস্তার মােড় থেকে ছয়রাস্তার দিকে আসতে বর্তমান নূরুন্নাহার হসপিটালের পাশের যে বিমলা ভবন, ঐ বাড়িটাই মহকুমা প্রশাসনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। রেনউইক কোম্পানির পাশে গড়াই নদীর ধারে বাড়িটি নদীর ধার ঘেঁষে যা পরবর্তীতে বহুদিন জেলা প্রশাসকের বাংলােবাড়ি ছিল। আজকের গড়াই নদী এখন যা দেখি আমরা, এটা একদা মঙ্গলবাড়িয়ার মাঝদিয়ে বয়ে মরা গড়াই সােজা আমলাপাড়ার পূর্ণবাবুর ঘাট থেকে পূর্বমুখী হয়ে একটি শাখা শ্মশানের কাছে যেয়ে আরেকটি শাখা বের হয়ে কলিগাঙ্গা নামে বয়ে যায় দক্ষিণ মুখে। যেটা বর্তমানে মরা কালিগঙ্গা নামে পরিচিত। আর ঐখানে বাঁকে কোণার ভর উত্তরপশ্চিম প্রান্তে ১৮৬২ সালে রেল কোম্পানির (তখন রেনউইক কোম্পানি) কারখানা হয়। বেকি দালান আর রেল কোম্পানির কারখানা মিলিয়ে একটি ব্রিজ আঁকলে যে এলাকাটি গড়ে ওঠে, তা-ই ছিল কুষ্টিয়ার সাহেবপাড়া, মহাকুমার সদর দপুর এলাকা। ১৮৬৫ তে জগতি রাইনি তথা কুষ্টিয়া রেলস্টেশন, ১৮৭১ এ গড়াই ব্রিজ হবার পরে তা সরাসরি গােয়ালন্দ পর্যন্ত চলে যায়।

ইংরেজরা তখন পূর্ববঙ্গকে গাঙ্গেয় নিম্নাঞ্চল বলতাে। এটা ঠিক আমরা এখনও বৃহত্তর কুষ্টিয়ার আশেপাশে যা ভূমিঅবস্থা দেখি, তাতে অনুমেয় যে সমগ্র এলাকা বিল বাওরে এলাকা বলেই সমাদৃত ছিল। বাংলার বেশির ভাগ জেলার মতাে এ এলাকার আমজনতাও ছিল নিরক্ষর কৃষিজীবী মুসলমান। বেশিরভাগেরই পদবী ছিল বিশ্বাস প্রামাণিক ও মণ্ডল। ব্যবসার জোতদারি থাকলেও তাদের সংখ্যা ছিল নগণ্য।

প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির চাকুরিজীবী নেই বললেই চলে। নাগরিকসমাজ চালাতে যে সমাজব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল তাও ইংরেজদের পছন্দমতাে। তার নেতারা বা মধ্যমণি ছিলেন বেশির ভাগই হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। কুষ্টিয়ার নাগরিকসমাজ তখনকার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত ডাক্তার উকিল শিক্ষক তথাকথিত নব্য ইংরেজি শিক্ষিত ব্রিটিশ সভাজন। এই সময় নিম্নবর্ণের হিন্দুসম্প্রদায়ের লােক বৌদ্ধ ধর্মে দিক্ষিত হয়। বিশেষ করে নাথ সম্প্রদায়ের বেলায় দেখা যায় এটা খুবই কার্যকর ছিল। কেননা ব্রাহ্মণ্যবাদ থেকে সরে এসে তখন মানুষ আরও অস্ট্রিক মঙ্গল আলপাইন নৃগােষ্ঠীর সৃষ্টি করে এবং সেটাই আদিবাসী। বাকি সবাই ভদ্র বাঙালি বলে পরিচিত। এই জাতিভেদ পুরাতন আমল থেকে ইন্দো-পাক জনগােষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য, যার ধারাবাহিকতা আজও আমাদের মধ্যে বিরাজ করছে। এই সময় আমাদের অঞ্চলে সাধক সুফিদের আগমন ঘটে, তারা ইসলাম প্রচারে যথেষ্ট প্রসার ঘটাতে সক্ষম হন। তাই আজও আমাদের এই এলাকার মানুষ দরগাহ সুফি সাধকদের কবরপূজায় মত্ত। নিম্নাঞ্চল বিধায় এখানে কুষ্টা বা পাটের চাষ বেশি হতাে, এই কুষ্টা থেকেই করা হয় (মতান্তরে কুষ্টে বা কুষ্টা। থেকেই) কুষ্টিয়ার নামপত্তন। যেমন এখনও আমাদের প্রবীণ মুখে এই কুষ্টে শব্দটি শােনা যায়। আরও কিছু কথা যেমন হবিনি, যাবিনি করবিনি এটা আঞ্চলিক ভাষায় রয়েই গেছে।

কুষ্টিয়ার কথা বলতে গেলে কুমারখালীর কথা না লিখলে হয় না। কারণ অবিভক্ত ভারতে কুমারখালীর অবস্থান অনেক পরিচিত ছিল এবং এখনও যদি কলকাতা বড়াে বাজারে যাই, দেখা যাবে সেখানকার বড়াে বড়াে কাপড় ব্যবসায়িরা অধিকাংশই কুমারখালীর লােক। এবং তারা আগে কুমারখালীকে চেনে, তারপরে কুষ্টিয়াকে।

কুষ্টিয়া একসময়ে রাজশাহী এবং যশােরের অধীনে থাকলেও ১৮ শতকেই ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির গঞ্জ গড়ে উঠেছিল এখানে, যা আজও চলছে। ১৮৭০ সালে রেশমকুঠিতে দাবি দাওয়া নিয়ে বিদ্রোহ হয় এবং অনেক লােক মারা যায় ইংরেজ সেনারও মৃত্যু হয়েছিল, তার প্রমাণ মেলে কুমারখালী স্টেশনের সামনে খ্রিস্টান কবরস্থান থেকে অনেক ফলকের গায়ের লেখা থেকে।

কেউ কেউ বলেন রেনেলে কুমারখালীর হদিস মেলে। ১৮২৫-২৬ সালে বিশপ হেবার পূর্ববঙ্গভ্রমণে নদীপথে এসে কুমারখালীতে কিছু সময় কাটিয়েছিলেন। ১৮৭১ সালে কুমারখালী মহকুমা থানায় পরিণত হয় এবং নদীয়া জেলার অধীনস্ত হয়। ১৮৫৭তে গড়ে ওঠা এমএন. হাই স্কুল তার ঐতিহ্যের দাবিদার। ১৮৫৮তে প্রথম ২ জন এস্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। জানা যায় সে সময় ঐ স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন কৃষ্ণধন মজুমদার। ঐ স্কুলের এক ছাত্র রমেশচন্দ্র দত্ত (সিলিভিয়ান) তার পিতা ঈশানচন্দ্র ছিলেন তখনকার ডেপুটিকল্টের। | বর্তমান কুষ্টিয়ার কেনি রােড বাবর আলী গেট থেকে কোর্ট স্টেশনের পেছন দিয়ে চলে গেছে। এই কেনি সাহেবের নীলকুঠি ছিল কুমারখালীর শালঘরমধুয়াতে। কেনি সাহেবের সঙ্গে লড়াই হয়েছিল প্যারিসুন্দরীর যা বর্তমানে আমলাসদরপুর সেখানে। আরও শ্রুতি আছে বর্তমান আমলায় মনিশাহ নামের এক ধনাঢ্য ব্যক্তি, যিনি তখন দার্জিলিং টি-স্টেটের মালিকও ছিলেন। তারা এখানে বাস করতেন, তাদের ব্যবসা বাণিজ্য ছিল দার্জিলিঙে। প্যারিসুন্দরীর সাথে নীলকর সাহেবের যুদ্ধের সময় দেশিয় জমিদাররা আতাত করে ইংরেজ সাহেবকে সাহায্য করেছে। ফলে দেখা যায় এই বাংলায় মীর জাফরের মৃত্যু কোনােদিনই হয়নি। প্যারিসুন্দরীকে তখন সাহায্য করেছিলেন মির মশাররফ হােসেনের আত্মীয় সাঁওতার শাহ গােলাম আজম নামের একজন।

কুষ্টিয়া পৌরসভার গােড়াপত্তন হয় ১৮৬৯ সালে। ১৮৮৪ সালে প্রথম পৌরনির্বাচন হয়। তখনকার নিয়মে সমাজে উকিলদের বেশ গ্রহণযােগ্যতা ছিল, যার জন্য সরকারি উকিল হরিশচন্দ্র রায়কে চেয়ারম্যান মনােনীত করে। কমিশনারদের তালিকায় সেফাতুল্লার নাম পাওয়া যায়। মজমপুরের চৌধুরী পরিবারে প্রাচীন ঐতিহ্য ছিল। এই পরিবারের কওসের উদ্দিন আহম্মেদ ইউনিয়নপরিষদের পঞ্চায়েতপ্রধান প্রেসিডেন্ট ছিলেন। দীর্ঘদিন সমাজসেবার জন্য জনগণের কাছে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি তল্কালীন সরকারের পুরস্কার লাভ করেন। তার পুত্র ফজলুল বারি চৌধুরীও মজমপুর ইউনিয়নের দীর্ঘকালীন প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সেইসময় চাদ প্রমাণিক (হাটশহরিপুর নিবাসী), যার নামে থানাপাড়া ছয়রাস্তার মােড় থেকে নদীর ধারের রাস্তার নামকরণ বর্তমান। তিনিও সুনামের সাথে সমাজসেবাসহ সামাজিক কাজকর্ম করেছিলেন। তিনি সাহিত্যনুরাগী ছিলেন। ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ প্রদত্ত খানসাহেব উপাধি পেয়েছিলেন ইউনিয়ন বাের্ডের প্রেসিডেন্ট হারুন অর রশিদ হারুন মিয়াও। অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট গােলাম রহমানের পিতামহ তিনি। ঐ একই সালে খানসাহেব উপাধি পান আমলাপাড়ার খন্দকার শামসুল হক। তিনি গােস্বামী দুর্গাপুরের ইউনিয়নবাের্ডের প্রেসিডেন্ট ও অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। এই সাথে বর্তমান পৌরমেয়র আনােয়ার আলীর মামা মরহুম আব্দুর রহীম বহুদিন কুষ্টিয়া পৌরসভার তথা কুষ্টিয়া জনগণের অনেক সেবা করেছেন। বর্তমান মেয়র জনাব আনােয়ার আলী কুষ্টিয়াকে অলংকৃত করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট।

১৮৫৫’র সার্ভে ম্যাপ, ১৯৬৮-৬৯এর প্রধান নথি জমিদারির কাছ থেকে পাওয়া নথিপত্রে যা জানা যায়, এতদঞ্চল সর্বাধিক জোতদারি জমিদারি ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের হাতে। যার প্রতিশােধ করতে যেয়ে অনেক মানুষএর জন্ম হয়েছে। বাঘায়তীন একজন। সংস্কৃতি সম্বন্ধে বলতে গেলে এ অঞ্চলের সংস্কৃতির ভিত্তি ছিল কমি খরা বন্যা দুর্ভিক্ষ ও মড়কের সাথে লড়াই করে হওয়ার কথা ছিল লড়াক। ঠি ছিলেন নিয়তিবাদী বা ভাগ্যনির্ভরশীল। চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী ও মধ্যবিত্ত গড়ে তুলেছিলেন নগরসংস্কৃতি। তখনকার কুষ্টিয়ার সাধারণ মানুষরা সস ছিলেন তার যথার্থই প্রমাণ আজও বয়ে চলেছে পরিমল নাট্য থিয়েটার (গ সিনেমা হল) বর্তমান কেয়া সিনেমা। এখানকার বহু শিল্পী নামিদামী গুঞ্জী - তখন পদচারণা ছিল কলকাতা পর্যন্ত।

কুষ্টিয়ার সংস্কৃতিমনা মানুষদের মধ্যে যাদের নাম আসে তারা ছিলেন । হাকিমেরা। এখানে এরা সাহিত্যচর্চা করতেন। গৌরীশংকর আগারওয়ালার , হরিশচন্দ্রের নামে পার্ক, হাকিম মুনসেফরা সেখানে টেনিস খেলতেন | মধ্যবিতে সাহিত্যসম্ভার, যেমন দ্বারকানাথ অধিকারীর সুরঞ্জন কাব্য, কাঙাল হরিনাথের এক ব্রহ্মাণ্ডদেব, বিজয়-বসন্ত, রাজকৃষ্ণ, মুখােপাধ্যায়ের রজবালা, মিত্রবিলাপ, বাঙ্গালীর ইতিহাস, মীর মশাররফ হােসেনের বিষাদসিন্ধু, উদাসীন পথিকের মনের কথা, জলধর সেনের কাঙ্গাল হরিনাথ, প্রবাসচিত্র, অক্ষয়কুমার মৈত্রর সিরাজউদ্দৌলা, চরণদাসের মনের কথা অনেক কথা, জগদীশ গুপ্তের লঘুগুরু, বসন্তকুমারের লালন ফকির, মােহাতার হােসেনের নজরুল কাব্য সমীক্ষণ। এই এলাকার মানুষ ছিল বড়ােই ধর্মভীরু। ধর্মবিশ্বাসের ভিন্নতা মানুষের সামাজিক সম্পর্কে কোনাে বাধা ছিল না। গােস্বামী দুর্গাপুর ১৬৭৪ রাধারমণের মন্দির। ১৮৩৫ এ খােরশেদপুরে রানীভবানীর গােপীনাথ মন্দির। কুষ্টিয়া শহরে ১৯০০ সালে নলডাঙ্গার রাজা নির্মিত রথখােলাসহ। গােপীনাথ মন্দির। আমলাপাড়ার ব্রাহ্মনেতা উকিল দুর্গাচরণ বিশ্বাসের ব্রাহ্মসমাজ গৃহে (সারদা বিদ্যালয়) এখন ৪নং পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঝাউদিয়া শাহি মসজিদ। কুষ্টিয়া বড়াে জামে মসজিদ ১৮৬৮ সালের আগস্ট মাসে মুদ্রিত কোহিনুর পত্রিকায় মুদ্রিত মীর মশাররফ হােসেনের একটি সম্প্রসঙ্গ নামের লেখা সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়া মুনসেফি আদালতের একজন হিন্দু মুনসেফের উদ্যোগে এখানকার কর্মচারীদের নামাজের সুবিধার্থে একটি ওয়াক্তিয়া মসজিদ তৈরি হয়, স্থানটি ছিল বাড়াদির (সাহা) জমিদার মাখনলাল রায়চৌধুরীর বাড়ি। ১৮৯৬ সালে এওয়াজসূত্রে শেখপাড়ার জমিদার আতাউলএর সান্তবান হন। তিনি এখানে জামে মসজিদ তৈরি করেন। গড়াই কালিগাঙের মুখে হিন্দু সম্প্রদায়ের শুশানভূমির জায়গাটুকু, জানা যায় ছোয়ায় জোতদার মইন উদ্দিন বিশ্বাসের চাপড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মােজাম্মেল হক কেরু মিয়ার পিতার অধিকারভুক্ত ছিল। অনুমান ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান। সম্প্রদায়ের (ক্যাথলিক) গীর্জা ছিল বতৃমান মিশন স্কুলের পশ্চিম প্রান্তে একটি কাঁচাঘর বর্তমান চার্চ অব বাংলাদেশের একটি ডায়ােসিস। এটির সংলগ্ন স্কুলটি ১৮৯৮ সালে উদ্বোধন করেন কুষ্টিয়ার চেয়ারম্যান এবং রেনউইকের মালিক রেনউইক সাহেবের পত্নী।

মজমপরের খ্রিস্টান গােরাস্তান উদ্বোধন করেন কলকাতার আর্চবিশপ কটন, ১৮৬৬ সালে। এই গােরস্তানের সামনেই অবস্থিত আজকের জিলা স্কুল। স্থাপিত ১৯৬৩ সাল। ১৯০৯-১০ সালে কুষ্টিয়া হাইস্কুল স্থাপন করা হয়।

শিল্প কল-কারখানা বলতে তখন এই অঞ্চলে কিছু ছিল না। তবে শিলাইদহ ঠাকুর বাবুরা দ্বারকানাবের আমলে চিনিকল স্থাপন করেন। এই দ্বারকানাথই ১৮৩৭ সালে কুমারখালী রেশমকুঠির মালিক উইলিয়ামের কাছ থেকে গােটাকতক কুঠি কিনেছিলেন। এখানকার মিলপাড়া এলাকা টেগােরলজএর গােড়াপত্তন হয়েছিল শিলাইদহের ‘ঠেগাের এন্ড কোম্পানি' নামে। এদের কারবার ছিল আখ মাড়াই, পাটের গাঁট বাধা ও ভূষিমালের সঙ্গে ছিল তাঁত কারখানা। রবীন্দ্রনাথ তার ভাইপােদের সথে ব্যবসা করতে গিয়ে অনেক লােকসানের মুখে পড়েন। শেষে তার জমিদারির কর্মচারী যজ্ঞেশ্বরের কাছে সময় ব্যবসা নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেন। তখন সেটি যজ্ঞেশ্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস’ হয়।

১৯০৬ সালে সুরকি ভাঙ্গা কল এবং পরে ১৯০৮ সালে যা ছােটো একটি তাঁতশিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছিল চক্রবর্তী এন্ড সন্স’ নামে, সেটিই পরবর্তীকালে ‘মােহিনী মিলস’এ পরিণত হয়। এর অংশীদার হিসাবে মােহিনীমােহন চক্রবর্তী (অবরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট) জগকিশাের (আচার্য চৌধুরী কানু বাবুর মাতামহ এবং রবীন্দ্রনাথের নাম জানা যায়। রেনউইক কোম্পানি আমলে ছিল রাজশাহীর লক্ষণহাটির ওয়াটসন কোম্পানির কারবার। এটি উঠে গেলে এদের ইঞ্জিনিয়র। রেনউইক সাহেব কুষ্টিয়াতে রেল কোম্পানির পরিত্যাক্ত কারখানাটি কিনে নেন। গড়ে তােলেন বেনউইক কোম্পানি। পুরানাে দিনের কলকারখানা বলতে এই ছিল এ এলাকার একটি কারবারি চিত্র।

শিল্পের ক্ষেত্রে বর্তমান কুষ্টিয়ার আর একটি দিক রয়েছে। এখানকার মাটিরও কিছু গুণ আছে। এ প্রজন্মের সামনে উদাহরণ হিসাবে একজন নিবেদিতপ্রাণ শিল্পপতি যার নাম না লিখলে ইতিহাস হাসবে। যিনি শিল্প তৈরির জন্যই কুষ্টিয়ার হাটশহরিপুরে জন্ম নিয়েছিলেন। অনেক কষ্টের মধ্যদিয়ে হাটি হাটি পা পা করে আজকে বিসিক | শিল্পনগরী প্রায় সম্পূর্ণ এলাকোতে তার তৈরি শিল্প দিয়ে শিল্পনগরী গড়তে সক্ষম হয়েছে। তার তৈরি শিল্প প্রতিষ্ঠানের নাম বিআরবি, কেবলস, যার প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব মজিবর রহমান, যিনি একাধারে অনেকগুলাে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা এবং এখনও নতুন কিছু তৈরিতে সচেষ্ট। একদা মােহিনীমিলের কারণে কুষ্টিয়ার অর্থনৈতিক যে চাঙ্গাভাব ছিল, মধ্যে মিল বন্ধের কারণে সেটাতে ভাটা পড়ে। এখন আবার তা বেড়ে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু তারই প্রতিষ্ঠিত শিল্পে কারখানার জন্য এবং তারই দূরদৃষ্টির জন্য।

এছাড়া খাজানগরের কথাও উল্লেখ করতে হয়। খালবিলে নদীবেষ্টিত কুষ্টিয়ার একফসলি ও আধাফসলি জমির কারণে এখানে ধান ও পাটের ব্যাপক চাষবাদের কথা শুনে এসেছি। কিন্তু যন্ত্রচালিত কৃষির উন্নতির কারণে আজ কুষ্টিয়া ধানের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। যার কারণে খাজানগরের বিশাল এলাকা চাউলের শিল্পনগরীতে পরিণত হয়েছে। খাজানগরের চাউলের যথেষ্ট সুনাম দেশে ও দেশের বাইরে। ইতিমধ্যেই সমাদৃত হয়েছে।

বারবার বলা হয়েছে এখানকার মানুষ শান্ত প্রকৃতির, সহনশীল এবং কিছুটা নিঃস্বার্থ বৈরাগী। এ কথা শতভাগ ঠিক নয়। প্রয়ােজনে যে তারা দুর্বার হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণও আছে। কুমারখালীর ওহাবিনেতা কাজী মিয়াজানের আন্দোলন, নীলকর, জোতদার জমিদারদের বিরুদ্ধে কাঙাল হরিনাথের গ্রামবার্তা প্রকাশিকা, শাস্ত্রহীন বাউল সম্প্রদায়ের হাতে লাঠি ওঠা, ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে বাঘাযতীনের সম্মুখলড়াই । শ্রমিক আন্দোলনে কমরেড রওশন আলী ও গারিস উল্লাহার ভূমিকা, স্বাধিকার আন্দোলনে সামিল হওয়া এবং অবশেষে স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালি অংশ নেবার মধ্য দিয়েই আজকের এই স্বাধীন সার্বভৌম যে বাংলাদেশ, তার জন্য লড়াই করে জান দিতেও কুষ্টিয়ার মানুষ পিছপা হয়নি। যার জ্বলন্ত উদাহরণ হিসাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কুষ্টিয়ার কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এবং থাকা উচিত, এবং সেই আমাদের প্রত্যাশা।

তথ্যসূত্রঃ- এসাে মিলি প্রাণের বন্ধনে, সম্পাদক: ডা. সাইফুল আলম, অধ্যাপক ডা. কাজী সফিকুর রহমান, বিলু কবীর, কাজল তালুকদার, প্রকাশক : ডা. মর্তুজা মজিদ বকুল, কুষ্টিয়া জিলা স্কুল এর সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন পর্ষদ ২০১১, নভেম্বর ২০১১, পৃষ্ঠা ৩৬-৩৮।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন