বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

মগ, পর্তুগীজ, ফিরিঙ্গী-জলদস্যুদের আবির্ভাব
মগ, পর্তুগীজ, ফিরিঙ্গী-জলদস্যুদের আবির্ভাব

মগের মুল্লুক, বোম্বেটে, হার্মাদ, ফিরিঙ্গী এ অঞ্চলে তথা বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত প্রবাদ ও বিদ্রুপাত্মক শব্দ। এছাড়া পেঁপে, পেয়ারা, কামরাঙ্গা, বাদমী, আমলকী, বেদানা, কমলা, বরান্দা, বোডার্স, বোতল, বালতি, গামলা, পেরেক, মাস্তুল, তুফান, কামান, পিস্তল, গীর্জা, পাদ্রী, মিস্ত্রী, এসব শব্দ পর্তুগীজ ও ফিরিঙ্গীদের থেকে এসেছে।

আমরা ফিরিঙ্গী খোঁপা বাঁধার কথা বলি, মেয়েদের আচার ব্যাবহারের ক্ষেত্রে ফিরিঙ্গী বলে থাকি। কামিজ, ইস্ত্রি, বছর, কাবাট, পুস্তক, ছাপা, জোলাপ, নিলাম ইত্যাদি তাদের ভাষাই আমাদের ভাষা হয়ে গেছে। এ অঞ্চলে মগো ব্রাহ্মণ, মগো বড়ই, মগো নাপিত, কর্মভেদ বংশধারা মগোদের থেকে এসেছে। সর্বোপরি সেবাসটিয়ান গঞ্জালেশ পর্তুগীজ জলদস্যুর নামানুসারে গোয়ালন্দ নামকরণ এবং সংগ্রাম সাহের ইতিহাস এ অঞ্চলের পর্তুগীজ মগ জলদস্যুদের স্মরণ করায়। মগ-ফিরিঙ্গী জলদস্যুদের উৎপাত, উপদ্রব, লুণ্ঠন বিষয়ে জানার আগে তাদের পরিচিতি বিষয়ে জানা যাক।

মগদের আগমন ঘটত বার্মার আরাকান থেকে। আরাকানের স্থান চট্রগ্রামের দক্ষিণে। পূর্বে তা আরাকান রাজ্য নামে পরিচিত ছিল। এর রাজধানী ছিল রামাবর্তী আরাকান মুসলমান শাসনভুক্ত থাকে। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে আরাকান রাজ্য ব্রহ্মবাসীরা কেড়ে নেয়। ১৮২৬ সালে ইংরেজ অধিকৃত হয়। এখন আরাকান মায়নমারের বিভাগ এবং রাজধানী আকিয়ার। আরাকান সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ায় তার নৌবিদ্যায় পারদর্শী ছিল। বাণিজ্য বা রণসজ্জায় আরাকানীরা উত্তরে চট্রগ্রাম আসত এবং সন্দ্বীপ তাদের প্রধান আড্ডা ছিল। তারা সাধারণত মগ বলে পরিচিত ছিল এবং তাদের ধর্ম বৌদ্ধ। একসময় তাদের ব্যবসাই ছিল দস্যুতা। পর্তুগীজরা এসেছিল সুদূর ইউরোপের পর্তুগাল থেকে। ১৫শ শতাব্দীদে ভাস্কোদাগামা তাদের এদেশে আসার পথের সন্ধান করে দেন। ধীরে ধীরে পর্তুগীজরা পশ্চিম ভারতের সমুদ্র তীরবর্তী নানা স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘাঁটি স্থাপন করে। এছাড়া তারা ঘাঁটি গেড়েছিল ইন্দোনেশিয়ার তিমুরে, চীনের ম্যাকাওতে, বঙ্গের সন্দীপে, আর ভারতের গোয়া ও বোম্বেতে। অল্পকালের মধ্যে তারা গোয়ানগরীতে দূর্গ ও রাজধানী স্থাপন করে। বঙ্গকে তখন ভারতের ভূস্বর্গ বলা হত। ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে পশ্চিম ভারত থেকে পর্তুগীজগণ এসে আরাকান সন্দ্বীপ ও সমুদ্রতীরের নানা স্থানে বসবাস করতে থাকে।

সে সময়ে ছিল মোগলদের শাসন। মোগলরা সাগরের দস্যুতা দমনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করত। এ সময় নৌবিদ্যায় পারদর্শী ও ভীনদেশী পর্তুগীজদের মগেরা আশ্রয় দিয়েছিল। পর্তুগীজরা দুঃসাহসিক অভিযান ভালোবাসত। স্থান দখল, দস্যুতা, বাণিজ্য ছিল তাদের রক্তে মিশ্রিত। ধীরে ধীরে তারা বঙ্গে ব্যবসা, দখল, দস্যুতা নানা উদ্দেশ্যে দলে দলে এসে বঙ্গের দক্ষিণে আশ্রয় গ্রহণ করে। মাহমুদ সাহের রাজত্বকালে পর্তুগীজরা চট্রগ্রামে ও সপ্তগ্রামে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপনের আদেশ পায়। পর্তুগীজরা নৌবাহিনীর নিরাপদ স্থানকে বন্দর বলত। এই বন্দর হতে ব্যান্ডেল এবং তা থেকে বেন্ডিট (দস্যু) শব্দের উৎপত্তি। পশ্চিম ভারতে যে সব পর্তুগীজ বাস করত তারা গুরুতর দুর্বৃত্ততার জন্য অপরাধী হত। তারা শাস্তি পাওয়ার ভয়ে বঙ্গে পলায়ন করত। বোম্বাই (বর্তমান মুম্বাই) হতে আসত বলে তাদের বলা হত বোম্বেটে। দস্যুতাই ছিল তাদের ব্যবসা। এদেশে এখনো চরিত্রহীন, ফটকাবাজ লোকদের বোম্বেটে বলে। রাজবাড়িতে এ শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার আছে। সে সময় সন্দ্বীপ বা সোমদ্বীপ বঙ্গোপসাগরের মধ্যে একটি উর্বর দ্বীপ। উৎপন্ন শস্য ও পণ্যের জন্য নাম ছিল স্বর্ণদ্বীপ এবং তা থেকেই হয় সন্দ্বীপ। দ্বীপটির আকার তখন ছিল ১৪ মাইল দীর্ঘ আর ১২ মাইল প্রশস্ত। সন্দ্বীপ তখন ভারতের প্রধান লবণ ব্যাবসার কেন্দ্র ছিল। প্রতিবছর দুইশতেরও বেশি জাহাজ নবণ বোঝাই করে নিয়ে যেত। ক্রমে সেখানে মগ ও পর্তুগীজদের বসতি স্থাপন হয়। তাদের পূর্বে সেখানে মুসলমানেরা বাস করত। পর্তুগীজদের অনেকে স্ত্রী নিয়ে আসত না। তারা ক্রমে এদেশে বিবাহের অনুমতি পায়। যে সব পর্তুগীজদের দুর্বৃত্তায়নের জন্যে এদেশে পালিয়ে আসত তারা এদেশে বিবাহ করত। কেউবা একাধিক বিবাহ করত আবার কেউ উপপত্নি রাখত। তারা বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিত। আবার অনেকে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে দস্যুতাতে লিপ্ত হত। এছাড়া গোয়ায় ও বোম্বে উপনিবেশবাদী পর্তুগীজদের অনেকটাই ইন্দ্রীয়সেবায় মত্ত হয়ে এদেশীয়দের স্ত্রীলোকের সংস্পর্শে বর্ণশঙ্কর জন্ম দিত, তারা ফিরিঙ্গী নামে পরিচিত হত।

মগ, পর্তুগীজ ফিরিঙ্গীর দল ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে এমন দস্যুবৃত্তি আরম্ভ করেছিল যে, বঙ্গে তখন কোনো শাসনই ছিল না। মগ ও ফিরিঙ্গী দস্যুগণ বঙ্গের দক্ষিণদিক হতে নদীপথে দেশের মধ্যে যেখানে সেখানে প্রবেশ করে লণ্ঠন, গৃহদাহ ও জাতিনাশে লিপ্ত হত। বঙ্গের শান্ত পল্লীগুলি শ্মশানে পরিণত হওয়ার উপক্রম হল। বার্ণিয়ের ভ্রমণকাহিনী থেকে জানা যায় চৌর্য আর দস্যুতাই ছিল তাদের প্রধান ব্যবসা। তারা দ্রুতগামী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাহাজ নিয়ে নদীনালা বেয়ে শতাধিক মাইল পর্যন্ত দেশের ভিতরে প্রবেশ করত। শহর, বাজার কিংবা বিবাহের দ্রব্যাদির সংবাদ পেলে সেখানে আক্রমণ করত এবং যা পেত তা লুটে নিত। স্ত্রীগণকে ধরে নিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিত।

বাড়ি ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিত আর মগ ও ফিরিঙ্গী দস্যুগণ জলপথে এসে কেবল লূট করত না তারা হিন্দু মসলমান স্ত্রী - পুরুষ ধরে নিয়ে যেত। তারা বন্দিদের হাতের তালূ ছিদ্রি করে তার মধ্যে শক্ত বেত চালিয়ে দিত এবং এভাবে গেঁথে তাদের জাহাজের পাটাতনের নিচে একটার পর একটা স্তুপীকৃত করে নিয়ে যেত। লোকে যেমন মুরগীর খাবার হিসেবে চাউল ছিটিয়ে দেয় এরুপ সকাল বিকালের অসিদ্ধ চাউলের মুষ্ঠি খাবার হিসেবে ছিটিয়ে দিত। এমন খাদ্য খেয়ে যারা বেঁচে থাকত দস্যুরা তাদের দেশে নিয়ে কঠিন কাজে নিয়োজিত করত। অনেককে দাক্ষিণাত্যে নিয়ে ওলন্দাজ ইংরেজ ফরাসীদের নিকট বিক্রি করে দিত। তাদের এ অত্যাচার দক্ষিণ বঙ্গে প্রায় সকল স্থানে এবং হুগলি পর্যন্ত বিস্তৃত লাভ করে। তাদের অত্যাচারে অনেক স্থান বিরাণভুমিতে পরিণত হয়েছিল। সম্রাট শাহজাহান ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দ হুগলি থেকে তাদের বিতাড়িত করেন। চট্রগ্রাম থেকে ফরিদপুরসহ অত্র অঞ্চলে তারা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। গ্রামে এসে যে মুল্লুকের ওপর পড়ত সেখানে শাসননীতি থাকত না। এমন অঞ্চলকে মানুষ মগের মুল্লুক বলত। এসব কথা এখনো এ অঞ্চলে প্রচলিত আছে। যশোর রাজা প্রতাপাদিত্য তাদের দমনের জন্য বহু সংখ্যক দুর্গ নির্মাণ করেছিল এবং অনেকাংশে তাদের মৃত্যুর পর মগ পর্তুগীজ ফিরিঙ্গীর দল আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সেবাসটিয়ান গঞ্জালেশ কার্ভালহের নেতৃত্বে তাদের অত্যাচার শুরু হয় যা প্রায় ৫০ বছরের অধিক কাল স্থায়ী হয়। পুর্তুগীজদের নৌ বিহারের নাম ছিল আর মার্তা। তা থেকে ফিরিঙ্গী জলদস্যুদের হারমাদ বলত। কথাটি এ অঞ্চলে এখনো প্রচলিত। কবি কঙ্কন চণ্ডিতে-----‘ফিরিঙ্গীর দেশখান বহে কর্ণধার, রাত্রি দিন বহে ডিঙ্গি হারমাদের ডরে।’ জানা যায় ডোমিঙ্গ কার্ভালোহ সন্ধীপে থেকে বিতাড়িত হওয়ার কালে বিক্রমপুরের রাজা কেদার রায়ের মেয়ে রাজকন্যা অঞ্জালিকা চৌধুরীকে সাথে নিয়ে যায়। ডোমিঙ্গ কার্ভালোহ তিমুরের পূর্বাংশে একটি মহরের নাম দিয়েছিল ভারত রাজ্যের রাজধানী দিল্লীর নামে।

মগ, ফিরিঙ্গী, পর্তুগীজদের এখনো অনেক স্মৃতি বিদ্যামান। এখনো দক্ষিণবঙ্গের অনেক স্থানের নাম ফিরিঙ্গী খাল, ফিরিঙ্গীর বাজার। মগ ফিরিঙ্গীরা যে সব বাড়ি বা পরিবার হানা দিত সমাজে তাদের পতিত বলে গণ্য করা হত এবং পরিবারকে মগো ব্রাহ্মণ, মগো বৈদ্য, মগো কায়েত, মগো নাপিত বলা হত। এখনো মাগুরা ফরিদপুরের অভ্যন্তরে ভূষণা প্রভৃতি স্থানে মগো পরিবার শ্রেণির লোকের বসবাস রয়েছে।

সেবাসটিয়ান গঞ্জালেশ, কার্ভালোহ পর্তুগীজ জলদুস্যুর দল সে সময় রাজবাড়ি অঞ্চলে ব্যাপক দস্যুতায় মেতে ওঠে। তার সে সময় পদ্মার কূল ধরে এ অঞ্চলে প্রবেশ করত। বর্তমান গোয়ালন্দ ছিল তাদের এ অঞ্চলের প্রধান আস্তানা। দস্যুদের দল রাজবাড়ি অঞ্চলের হড়াই, গড়াই, চন্দনা নদীর তীর ধরে ভিতরে প্রবেশ করে দস্যুতা চালাত। কথিত আছে পুর্তগীজ জলদস্যুদের দ্বারা বেগম মোমতাজমহলের দুইজন দাসী অপহৃত হয়। পুর্তগীজদের এ অত্যাচার দমনের জন্য ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে কাসিম খানের নেতৃত্বে তাদের অবরোধ করেন। যুদ্ধে পুর্তগীজরা বহু সৈন্য নিহত হয়। তারা পরাজিত হলেও পরে আরাকানী মগদের সাথে মিশে ভাটি অঞ্চলে লুটতরাজ আরম্ভ করে। সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে মীর জুমলাকে বাংলার সুবেদার করে পাঠান। এ সময় রাজবাড়ি অঞ্চলের মগ, পর্তুগীজ দস্যুদের দমনের জন্য রাজা সংগ্রাম সাকে অত্র অঞ্চলের নাওয়াড়া প্রধান করে পাঠান হয়।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন