বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

মোহিনী মোহন চক্রবর্তী
মোহিনী মোহন চক্রবর্তী

সেই সময়ের নদীয়া ও এখনকার কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী সর্বকালেই এক অভিন্ন ও স্বতন্ত্র ধারার পরিচয়ে পরিচিত। রাজনীতি থেকে সমাজ ব্যবস্থা, প্রশাসনিক বিন্যাস থেকে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে অর্থনৈতিক স্তর— সবকিছুতেই যেন অন্য সব এলাকার সঙ্গে বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য ছিল। কুমারখালীতে জল যোগাযোগের সহজ মাধ্যম ছিল। একসময়ের গৌড়ি বা এখনকার গড়াই নদীর তীরঘেঁষা আবার পদ্মার তীরবর্তী হওয়ায় এটি অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে দ্রুত প্রতিষ্ঠা পায়।

১৮৫৭ সালে কুমারখালী প্রথম মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। তখন বর্তমান রাজবাড়ী জেলার পাংশা ও বালিয়াকান্দি, কুষ্টিয়ার খোকসা, তদানীন্তন কুমারখালীর বর্তমানে বিলুপ্ত ভালুকা থানা কুমারখালী মহকুমার অন্তর্ভুক্ত ছিল। সে সময় এখানে একটি মুন্সেফ আদালত স্থাপন করা হয়, যে আদালতের প্রথম মুন্সেফ ছিলেন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সার্থক গ্রন্থকারিক সি আর দত্তের পিতা শ্রী ঈশান চন্দ্র দত্ত। ১৮৬১ সালে কুষ্টিয়া মহকুমা স্থাপিত হলে কুমারখালী মহকুমার অস্তিত্ব হরণ হয়। সাধ্যকথা হলো, ১৮৬০ সালে খোদ কলকাতার সঙ্গে এখানকার রেলযোগাযোগ স্থাপন সামগ্রিক ব্যবসার গতিধারা আরো বেগবান করে দিয়েছিল। তবে সবসময়ই কুষ্টিয়ার সাহিত্য-সংস্কৃতি, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, বাণিজ্য, অর্থনৈতিক যে বিষয়ই বলি না কেন, যুগের ধারায় তা ছিল কুমারখালীর প্রভাবে আবৃত। শ ম শওকত আলী তার ‘কুষ্টিয়ার ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পর থেকে কুমারখালীতে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির যে বিকাশ ঘটেছিল, তা বাংলার আর কোনো মফস্বল শহরে হয়নি। আবার কুমারখালীর রেশম ও নীল চাষের ইতিহাস খুবই পুরনো। এখানে সেই আদিকাল থেকে পতঙ্গ নামে এক রকম সুতা দিয়ে তসর কাপড় বোনা হতো। এখানে সাপ্তাহিক কাপড়ের হাট ছিল, যা এ বঙ্গে বেশ বড় ও প্রসিদ্ধ কাপড়ের হাট। এ কাপড়ের হাটে বেচাকেনা হতো লাখ লাখ টাকার সুতো, কাপড়, রঙ ও তাঁত সরঞ্জাম। ব্যবসা-বাণিজ্য ঘিরে এখানে গড়ে ওঠে বসতি এবং বণিক শ্রেণীর মানুষের সমন্বয়ে এক সমাজ ব্যবস্থা তথা সভ্যতার প্রেক্ষিত স্তর। সমাবেশ হতে থাকে সাহা, কণ্ডু, বণিক শ্রেণীর মানুষের এবং নীলকরদের সমাগম ঘটার সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে ব্যবসামনস্ক অন্যান্য শ্রেণীর মানুষ।

১৮৩৮ সালের ৬ জুলাই (১২৪৫ সনের ২১ আষাঢ়) ভারতখ্যাত কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সর্বসেরা কৃতী সন্তান স্বদেশী আন্দোলনের সাহসী সৈনিক, বিখ্যাত মোহিনী মিলের জন্মরাজ মোহিনী মোহন চক্রবর্তী এলঙ্গী পাড়ায় এক পরিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সে সময় বঙ্গীয় পুলিশ বিভাগের এক কর্মচারী কৃষ্ণলাল চক্রবর্তী ছিলেন এই গর্বিত সন্তানের পিতা। কুমারখালী শহরের নিকটবর্তী মুড়াগাছার রামানন্দ ভৌমিক মহাশয়ের দুহিতা ভগবতী দেবী ছিলেন মোহিনী চক্রবর্তীর গরীয়সী মাতা। পিতামহ নবকিশোর চক্রবর্তীও ছিলেন তদানীন্তন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীন কুমারখালী রেশম কুঠিরের বিশ্বস্ত দেওয়ান। মোহিনী মোহন চক্রবর্তীর পিতৃ ও মাতৃকূল উভয়েই ছিল অর্থবিত্ত প্রভাবিত এবং যুগের ধারায় প্রাচ্য আদর্শের অনুভাবনীয় অথচ ধর্মনিষ্ঠাবান ও ব্রাহ্মণ সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী। পাঁচ ভাই ও একমাত্র বোনের মধ্যে মোহিনী মোহন চক্রবর্তী ছিলেন সবার বড়।

যখন তিনি ২২ বছরের যুবক, তখন তাঁর বাবা এবং যখন তাঁর বয়স ২৭, তখন তাঁর মা দিব্যধামে চলে যান। উদ্বিগ্ন, বিচলিত, হতবিহ্বল মোহিনী মোহন নিজের পরিবারের বিশাল বহরের সঙ্গে সঙ্গে কতগুলো বিধবা-বিপন্না আর্তের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে এগিয়ে চললেন। কোনো রোগশোক বা দুঃখ-কষ্ট তাঁকে পেছনে নিতে পারেনি। একদিকে পরিবারের ভার, অন্যদিকে সমাজের দায়িত্ব— এরই মধ্যে নিজেকে তৈরি করতে চলছে তাঁর লেখাপড়ার সৌধ সাধনা। মোহিনী মোহন চক্রবর্তী ছাত্রজীবনে কোথাও কখনো দ্বিতীয় ছিলেন না। তিনি জুনিয়র ও সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান গ্রহণ করে বিদ্বত্ সমাজে তাঁর মেধার প্রমাণ দিয়েছিলেন। লেখাপড়ার দৌড়ে তিনি খুব ভালো ফল নিয়ে এন্ট্রান্স পাস করেছিলেন। যেখানেই তাঁর পড়াশোনা হোক না কেন, তিনি ১৮৫২ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ১৮৫৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ভারতের বর্ধমান (সম্ভবত) জেলার দি বোয়ালিয়াহ্ সরকারি বিদ্যালয়ে সাড়ে চার বছর জ্যামিতি, বীজগণিত, পাটিগণিত, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য, সাধারণ জ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং এখানে তিনি স্মরণযোগ্য ফল লাভ করেছিলেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৩/১৮৫৮ স্মারকে ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হুররো গোবিন্দ সেন স্বাক্ষরিত এক সনদপত্রে। তিনি যে পরিমাণ বিদ্যার্জন করেছিলেন, তা সে সমাজে ছিল অতি গ্রহণযোগ্য— এ কথার সত্যতা মেলে। যাহোক, কর্মজীবনে তিনি নিজের অর্জিত জ্ঞান ও কর্মদক্ষতায় কালবিলম্ব না করে মাসিক ১৮ টাকা বেতনে কুষ্টিয়া মহকুমা অফিসে করণিকের চাকরি গ্রহণ করেন। চাকরি গ্রহণের পর অফিসে মোহিনী মোহনের দক্ষতা, ন্যায়নিষ্ঠা, সহনশীলতা দিন দিন ভাস্বর হয়ে উঠতে লাগল। কর্তাব্যক্তিদের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা আর উপলব্ধিতা ক্রমে বাড়তে লাগল। মোহিনী চক্রবর্তীর কাজে মুগ্ধ হয়ে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে কুষ্টিয়া মহকুমার সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট স্যার আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জি এবং বাংলার সর্বময় কর্তা বঙ্গীয় লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার তাদের চাকরির বদলিজনিত সময়ে পুরস্কারস্বরূপ প্রথমে ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম পরে বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েটে সম্মানিত ও উপযুক্ত পদে পদায়ন করে যান। এখান থেকে মোহিনী বাবুর জীবনের চাকা ঘুরতে শুরু করে। এই দুই মহানুভব ব্যক্তির দয়া, আশীর্বাদ আর উত্সাহে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে পরীক্ষার জন্য তৈরি হলেন। তিনি সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিচারকের আসন বাগিয়ে নিতে সামর্থ্য হন।

ম্যাজিস্ট্রেট মোহিনী মোহন চক্রবর্তী। এখানেও রয়েছে তার কর্মজীবনের ব্যাপক উত্থান আর পতনের ঘটনা। তখন তিনি নোয়াখালীর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। সরকারি অর্থ আত্মসাত্ করার দায়ে অভিযুক্ত দুজনের একজন সেরেস্তাদার ও অন্যজন কর্মচারী ছিলেন। এ ঘটনার বিচারের ভার বর্তায় মোহিনী বাবুর ওপর। কালেক্টর সাহেব আগেই তাঁকে অভিযুক্ত দুজনকে শাস্তি প্রদানের জন্য বারবার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু দৃঢ়চেতা ও ন্যায়নিষ্ঠ বিচারক মোহিনী বাবু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে অভিযুক্তদের মুক্তি দেন। এতে মোহিনী বাবুকে কালেক্টর সাহেবের বিরাগভাজন ও রোষানলে পড়তে হয়েছিল বটে কিন্তু মোহিনী মোহন চক্রবর্তী এতটুকুও অবনমিত হননি। যেজন্য তাঁকে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি ও জেলার ভারপ্রাপ্ত কালেক্টর হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। তিনি যতটা ধর্মপরায়ণ ছিলেন, ঠিক ততটাই ছিলেন ন্যায়পরায়ণ ও অসাম্প্রদায়িক।

আরেকটি ঘটনা মোহিনী মোহন চক্রবর্তীর বিচারিক জীবনে রেখাপাত ঘটিয়েছিল। তিনি কোনো গুরুতর আসামিদের মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে তাদের দোষী সাব্যস্ত করতে পারেননি। কেননা এতে তাঁর বিবেক দংশিত হতে পারত বলে ন্যায়বিচারে আসামিদের মুক্তির আদেশ দিয়েছিলেন। বিষয়টি সর্বত্র চাউড় হলে কমিশনার মহোদয় কোনো নোটিস ছাড়াই মোহিনী বাবুর অফিস পরিদর্শনে এসে তাঁর বিচার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে উদ্যত হতেই মোহিনী বাবু আদালতে বসে নির্ভীক চিত্তে উত্তেজক মন্তব্য করেন— ‘Do you think Mr…I have sold my conscience for money?’ তাঁর এমন বিচার-বৈশিষ্ট্য ও কর্তব্য-বুদ্ধির জন্য তিনি ছিলেন জনপ্রিয় বিচারক।

আরেকটি ঘটনা। আমাদের বিচারক বাবু তখন ভাবুয়া (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) মহকুমায় কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ওই সময় বাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র এক বন্ধুসহ এখানে এসেছিল। হঠাত্ বন্ধুকে নিয়ে ছেলে এক বুদ্ধি আঁটল। বাবুর পরিচয় ও প্রভাবকে পুঁজি করে এক ব্যক্তির পুকুর থেকে তারা মাছ শিকার করে আনল। কান থেকে কানে এই কথা পৌঁছল বাবু পর্যন্ত। বিচারবিধাতা নিজ উদ্যোগে পুকুরের মালিককে ডাকলেন। পুত্র ও তার বন্ধুকে মুখোমুখি করে বললেন, ‘এরা আপনার পুকুর থেকে মাছ ধরে বড়ই গর্হিত কাজ করেছে। এদের বিরুদ্ধে আপনি থানা অথবা আদালতে নালিশ করুন। এদের অপরাধের সমুচিত বিচারের ব্যবস্থা করুন।’ সততা আর এই অমিয়তার জন্য তিনি ছিলেন সবসময় সবার কাছে আদৃত ও সমাহিত। তিনি অদ্যাবধি আমাদের কাছে যুগের ধারায় যে কারণে অমরগাথা, তা বলতে গেলে শেক্সপিয়ারের একটি কথা বলতে হয়। যেটা তিনি প্রায়ই বলতেন তা হলো: ‘I am armed so strong in honesty... Flattery is the food of fools’

মোহিনী মোহন চক্রবর্তী বেশ কিছুদিন ভাগলপুরে (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) জিলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর হিসেবে চাকরি করেছেন।

মোহিনী মোহন চক্রবর্তী বাল্যে মা-বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন আদর্শগত এক জীবন পাঁচালির অনুসংঘ। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেয়া হলো। বাল্যের আদর্শ, কৈশোরের পরিপূর্ণ মেধা, যৌবনের কর্মশক্তিতে দিন দিন হূদয়ে এমন এক বীজ উপ্ত হতে লাগল যে তাঁর স্বদেশের প্রতি মায়া ও হিতৈষীর আকাঙ্ক্ষা বাড়তে লাগল। অবসর সময় পার করতে কুষ্টিয়া শহরের বর্তমান জায়গায় বিশ্রাম নিতে নিতে মা-মাটি আর মানুষের প্রতি কর্তব্যের শিকড় বিস্তৃতির কর্মসাধনায় তন্ময় হয়ে পড়েছিলেন। মনের মধ্যে তখন দেশের শিল্প বিকাশের প্রয়োজনীয়তা থেকে স্বদেশী অনুরাগের প্রতি দৌর্বল্য তাকে দিন দিন প্রভাবিত করতে লাগল। পণ্য স্বদেশী, তা যতই হোক না কেন নগণ্য। আর বিদেশী পণ্য নয়। ১৯০৭ সাল। মোহিনী মোহন চক্রবর্তী ‘চক্রবর্তী অ্যান্ড সন্স’ নামে এক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৮ সাল। মাত্র আট খানা তাঁত নিয়ে ‘মোহিনী মিলস লি.’ নামে এক বস্ত্রকলের যাত্রা শুরু করেন। যে কলের মোটা শাড়ি ও ধুতি বাংলার ঘরে ঘরে এক পবিত্র সম্ভার হিসেবে সমাদৃত হয়েছিল। পরে তিনি কুষ্টিয়া ছাড়াও নদীয়া জেলার বেলঘড়িয়ায় দুই নম্বর মোহিনী মিলস গড়ে তোলেন। তবে এ কথা সত্য, এ মিল প্রতিষ্ঠার কারণে বাংলার মানুষের মধ্যে বিশাল এক আগ্রহ জাগ্রত হয়েছিল। বাংলায় তখন কোনো বস্ত্রকল ছিল না। সারা ভারতের মানুষের লজ্জা নিবারণে তখন নির্ভর করতে হতো ল্যাংকাশায়ারের ওপর। ভারতের বস্ত্রসামগ্রীর দাম নির্ধারণ করত এই ব্যক্তিই। মোহিনী বাবু এ বস্ত্রকল পরিচালনার জন্য তাঁর দুই ছেলেকে বোম্বে পাঠিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করিয়ে আনেন। দিন দিন যখন মিলের উত্পাদন ও বিপণন এগিয়ে যেতে লাগল, তখন সর্বসাধারণ মোহিনী বাবুকে এ বস্ত্রকলটিকে সাধারণের জন্য গড়ে তুলতে অনুরোধ জানাতে থাকেন। তিনি সাধারণের অনুরোধের প্রতি সদয় হয়ে ১৯০৮ সালে মিলটিকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করেন। এখানে যোগদান করে অনেক বাঙালি সন্তান তাদের অন্নের সংস্থান করতে থাকে।

কোনো দায়গ্রস্ত ব্যক্তি মোহিনী বাবুর কাছে এসে খালি হাতে ফিরেছেন, এমন নজির ছিল না। তিনি দান-ধ্যানের কারণে ছিলেন আর্তের সুহূদ ও বন্ধু। তিনি তখন আরায় অবস্থান করছিলেন। সেখানে তাঁর এক গৃহভৃত্য ছিল। তার নাম মাতারাম কাহার। এ ভৃত্য দুরারোগ্য ও সংক্রামক ‘বিসূচিকা’ রোগে আক্রান্ত হলে মোহিনী মোহন চক্রবর্তী এক বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক বাড়িতে রেখে তার চিকিত্সা করিয়েছিলেন। নিজে এবং ছেলেকে নিয়োজিত করে অনেক চেষ্টা করেও মাতারামকে বাঁচানো গেল না। মাতারাম তার মৃত্যুর আগে নিজের ব্যবহূত সুবর্ণ তাবিজ খুলে মোহিনী বাবুর হাতে অর্পণ করে। মোহিনী বাবু এ মৃত্যুতে বেশ বিচলিত হলেন বটে। তবে হিন্দুদের পবিত্র ধর্মীয় স্থান বারাণসীতে গিয়ে তিনি ব্রাহ্মণদের দিয়ে বেদ পাঠ করিয়ে ওই সুবর্ণ তাবিজ ব্রাহ্মণদের হাতে অর্পণ করেছিলেন, যা ছিল মাতারাম কাহারের শেষ ইচ্ছে।

পড়াশোনা ছিল মোহিনী বাবুর নিত্যদিনের কাজের অংশ। সংবাদপত্র ও বই পড়া ছিল তাঁর প্রতিদিনের কাজ। গভীর রাত পর্যন্ত পাঠাভ্যাস ছিল তাঁর। বাড়িতে একটি পুস্তকালয় ছিল বেশ সুসজ্জিত ও মনোরম। তিনি কোনো নেশায় আচ্ছন্ন ছিলেন না। মদ তো দূরের কথা, চুরুট কিংবা পান বা তামাকজাতীয় দ্রব্যও তিনি কোনো দিন স্পর্শ করেননি।

মোহিনী মোহন চক্রবর্তী ছিলেন বিদ্যোত্সাহী ব্যক্তি। পড়াশোনা করা এবং করতে সাহায্য করায় তাঁর ছিল প্রগাঢ় উদারতা। ১৮৭১ সাল মোহিনী মোহন চক্রবর্তী ছিলেন ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট। এখানে তিনি পরবর্তী সময়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটও হয়েছিলেন। ওই সময়ে কুমারখালীর ঐতিহাসিক ও কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ভাবশিষ্য জলধর সেনের পিতৃবিয়োগ ঘটে। জলধর সেন তার ভাই ও বিধবা মাকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। শরিকরা তাদের কোনো সহায়তা না দিয়ে প্রকারান্তে বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু তার জেঠতুতো দাদা ওই সময়ে গোয়ালন্দ মহকুমা আদালতের পেশকার ছিলেন। তিনি জলধর সেনদের গোয়ালন্দে এনে জলধর ও ভাই হলধর সেনকে গোয়ালন্দ মাইনর স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। জলধর সেন এখানে ১৮৭১ থেকে ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত ওই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তিনি এ সময়ে পরীক্ষায় বর্তমান বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার মধ্যে বেস্ট রেজাল্ট করে ‘রাজা সূর্য কুমার’ প্রবর্তিত রৌপ্য পদক লাভ করেন।

বিষয়টি ফরিদপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জানলেন এবং এও জানলেন জলধর সেন তাঁর জন্মভূমি কুমারখালীর সন্তান। যে কিনা রেজাল্ট ভালো করে এলাকারও মুখ উজ্জ্বল করেছে। পরে জলধর সেনকে ফরিদপুরে এনে জিলা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। তবে এ স্কুলে জলধর ক্লাস এইট পর্যন্ত মাত্র পড়েছিলেন (সূত্র: বাবু মল্লিক, সভাপতি, রাজবাড়ী প্রেস ক্লাব)।

শ্রমিকরা শুধু কাজ করে ঘাম ঝরাবে তা কি হয়? মোহিনী বাবু ১৯৩০ সালে মোহিনী মিলের কর্মচারীদের বিনোদনের জন্য মিলপাড়ায় গড়ে তোলেন ‘সান্ধ্য সমিতি’ নামে একটি থিয়েটার এবং তাদের সংবাদপত্র ও বই পড়ার জন্য লাইব্রেরি। সে সময় মোহিনী মিলের ফুটবল টিম ছিল কলকাতা দলের সঙ্গে টক্কর দেয়ার মতো পারদর্শী।

মোহিনী মোহন চক্রবর্তী নিয়মিত ধর্মীয় রীতি মেনে চলতেন। তিনি ধর্মীয় আচার সম্পন্ন করে আহার করতেন। সে আহার ছিল পরিমিত, তা যতই লোভনীয় খাবার হোক না কেন। তিনি চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পরেও ২৭ বছর পেনশন ভোগ করেছিলেন। তিনি নীরোগ অবস্থায় ৮৪ বছর চার মাস বয়সে ১৯২২ সালের ৪ নভেম্বর (বাংলা ১৩২৮ সালের ২০ কার্তিক) বয়সের প্রাকৃতিক ধারায় দিব্যধাম গমন করেন। যে প্রস্থান ছিল কালের প্রবাহে যুগ সৃষ্টি ধারায় এক অর্থমুক্তির অজবীথি ও বিচারবিধাতার নিঃশব্দ প্রস্থান।

ঋণ স্বীকার: বাবু সুনীল কুমার বাগচী, গাজনা, মধুখালী, ফরিদপুর। লেখক: গবেষক, উদ্ভাবক (জৈব বালাই নাশক), পরিবেশ ব্যক্তিত্ব ও পদক বিজয়ী প্রাবন্ধিক

সংগ্রহঃ বণিক বার্তা হতে - গৌতম কুমার রায়

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.