বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

ফকির লালন সাঁইজির জীবন ও দর্শন
ফকির লালন সাঁইজির জীবন ও দর্শন

Life and philosophy of Fakir Lalon Saijir

লালন কে? এই প্রশ্নটি অতি পুরাতন কিন্তু আজও চলমান। ফকির লালন সাঁই বিশ্বের মানুষের কাছে রহস্য ঘেরা এক জ্ঞানের ভাণ্ডার। তিনি সবার কাছে অবিসংবাদিত কিংবদন্তি প্রাণপুরুষ। তাঁর বাণী আমাদের মানবতা এবং সংস্কৃতিকে করেছে শ্রীবৃদ্ধি ও বিত্তশালী। সাঁইজির জন্ম রহস্য, গোত্র পরিচয় বা জাত-পাতের ব্যাপারে নিজেকে সব সময় রহস্য ঘেরা আবর্তে আবদ্ধ করে রেখেছেন।

তিনি কারো কাছে এমনকি তাঁর অতি প্রিয় শিষ্যদের কাছে কিংবা তাঁর পালিত পিতা-মাতার কাছেও তাঁর সাম্প্রদায়িক পরিচয় ব্যক্ত করে যাননি। “হিতকরী” পত্রিকা থেকে জানা যায় তিনি ১১৬বছর বয়সে দেহ ত্যাগ করেন। সেই হিসাবে সাঁইজির জন্ম ১৭৭৪ খ্রিঃ এখন পর্যন্ত এটাই স্বীকৃত তথ্যভিত্তিক। সাঁইজি ধর্মীয় পরিচয় চিরদিন পরিহার করেছেন। তাইতো সাঁইজি বলেছেন- “সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে, লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না এ নজরে” বা “সব বলে লালন ফকির কোন জাতের ছেলে, কারে কিবা বলি আমি দিশা না মেলে” বা “সবে বলে লালন ফকির হিন্দু কি যবন, লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান”। সাঁইজি জাতিভেদের অন্তঃসারশূন্যতার প্রতি দৃষ্টিপাত করে কটাক্ষ করে জাত সম্পর্কে বলেছেন- “লালন বলে হাতে পেলে, জাত পোড়াতাম আগুন দিয়ে”।

সাঁইজি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, গীতিকার, সুরকার ও মরমি সাধক। তাই সাঁইজির বাণী একই সঙ্গে সাধন সংগীত, দর্শন-কথা ও শিল্প-শোভিত কাব্যবাণী। বাক্যের গঠন ও শব্দের আধুনিকতা, হৃদয়গ্রাহ্য ভাব ও সুরের সমন্বয় সব মিলিয়ে কালের বিচারে লালনগীতি বাংলাসাহিত্যে এক অনন্য সহযোজন। সাঁইজির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের কোন সুযোগই হয়নি। কিন্তু তাঁর সংগীতের বাণীর সৌকর্য, সুরের বিস্তার, ভাবের গভীরতা আর শিল্পের নৈপুণ্য সব বয়সের মানুষকে মুগ্ধ করে। সাঁইজির বাণীর আধুনিকতা, শ্রæতিমাধুর্য ও সারল্য আজও আমাদের চুম্বকের মত আকর্ষণ করে। আসলে সাঁইজি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তাইতো সাঁইজি বলেছেন- “এলেমে লাদুন্নি হয় যার, সর্ব ভেদ মালুম হয় তাঁর”।

সাঁইজির বাণীতে সাম্প্রদায়িকতা-জাতিভেদ-ছুঁৎমার্গ- এই সব সমকালীন সমস্যাকে চিহ্নিতকরণ এবং সে সব সমাধানের ইঙ্গিত রয়েছে। এই প্রয়াসের মাধ্যমে সাঁইজি সমাজ সচেতন, মানবতাবাদী ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির যে পরিচয় দিয়েছেন তার স্বরূপ নির্ণয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদের উত্থানের কালে মনুষ্যত্ব-মানবতার লাঞ্ছনার সময়ে সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের বৈরী-যুগে সাঁইজির বাণী হতে পারে প্রতিবাদের শিল্প শান্তি ও শুভ বুদ্ধির প্রেরণা; মানুষের প্রতি হারানো বিশ^াসকে ফিরিয়ে আনার পরম পাথেয়। সাঁইজি ছিলেন মানবতার মুক্তির দিশারী। তাইতো সাঁইজি বলেছেন-“এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে, যে দিন হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান জাতি-গ্রোত্র নাহি রবে”।

সাঁইজির জীবন ইতিহাসে এ কথাই প্রমাণ করে যে, খুব সাধারণ হওয়ার সত্বেও সাহস বিশ^াসের ভক্তিতে একজন মানুষ জরাজীর্ণ-অনৈতিক-শোষণমূলক সামাজিক রীতিনীতিকে অস্বীকার করতে পারে। তাঁর বাণীতে ধর্ম-সমন্বয়, সম্প্রদায়-সম্প্রীতি, মানব-মহিমাবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, আচারসর্বস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বর্ণ-শোষণ-জাতিভেদের প্রতি ঘৃণা, সামাজিক অবিচার ও অসাম্যের অবসান-কামনা প্রভৃতি বিষয় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। মূলত তাঁর বিদ্রোহ ছিল প্রচলিত আনুগত্য, হৃদয়হীন শাস্ত্রাচার ও সমাজধর্মের বিরুদ্ধে। তাঁর বাণীর ভিতর দিয়ে সাঁইজির উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবতাবাদী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। আন্তরিক বোধ ও বিশ্বাসকে অকপটে সাঁইজি তাঁর বাণীতে প্রকাশ করেছেন। তাইতো এতকাল পরেও লালন আদরণীয় ও জনপ্রিয়। তাইতো সাঁইজি বলেছেন- “অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই, শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই, দেব-দেবতাগণ করে আরাধন, জন্ম নিতে মানবে”।

সাঁইজি শুধু যে ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কেই জ্ঞান রাখতেন তা নয়। তাঁর জ্ঞানের পরিধি সমকালীন সমাজ, গণিত, ভু-গোল, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি বিষয়কে ঘিরে। গণিতের বিষয়কে উপজীব্য করে তিনি তার তাত্ত্বিক ধারনাকে ব্যাখ্যা করেছেন। আঠারো শতকের একজন গ্রাম্য সাধারণ মানুষের পক্ষে এ ভাবে গণিতের বিষয়াবলীকে আশ্রয় করে বাণী রচনা একেবারেই অসম্ভব এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার গুরুত্ব অনুধাবন সত্যিই ভাবনাতীত। পৃথিবী গোল এবং সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘুরছে এ বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। আসলে সাঁইজি ছিলেন দিব্য জ্ঞানী। তাইতো সাঁইজি বলেছেন- “চেতন গুরুর সঙ্গে কর ভগ্নাংশ শিক্ষা, বীজ গনিতে পূর্ণমান হবে তাতে পাবি রক্ষা” বা “বাংলা শিক্ষা কর মন আগে, ইংরেজি মন তোমার রাখ বিভাগে” কিংবা “পৃথিবী গোলাকার শুনি, অহর্নিশি ঘোরে আপনি, তাইতে হয় দিন রজনী, জ্ঞানীগুণী তাই মানে”।

সাঁইজি তাঁর ভক্ত অনুসারীদের জন্য যে ধর্ম দর্শন প্রচার করে গেছেন তা গুরুবাদী ও দেহবাদী সাধনা। এ ধর্মের মূল হচ্ছে গুরুকে বিশ্বাস করা। গুরু বাক্য বলবান আর সব বাহ্য জ্ঞান। গুরু বাক্যই শিষ্য ও ভক্তের সাধনা-আরাধনা। ভবের হাটে মানুষ ভজে মানুষ হয়ে নিজের মাঝে সোনার মানুষের সন্ধান করে সর্ব-সাধন সিদ্ধি করা। তাইতো সাঁইজি বলেছেন- “ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার, সর্ব সাধন সিদ্ধি হয় তাঁর” কিংবা “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”।

এই দেহভান্ড হলো বিশ্ব ব্রক্ষান্ডের অণু সংরক্ষণ। বিশ্বব্রক্ষান্ড যে সব পদার্থ দ্বারা সৃষ্টি এই দেহ সেই সব পদার্থ দ্বারাই সৃষ্টি। অর্থাৎ এই মানব দেহ এবং বিশ্ব ব্রক্ষান্ড উভয়ই ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম অর্থাৎ মাটি, পানি, আগুন, বাতাস ও আকাশ দ্বারা তৈরি। সাঁইজি যে দেহের বাড়ীর ইংগিত করেছেন তা হলো মানুষের কলব এই কালবেই আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তার বাস। কালবিল মোমেনিন আরশুল্ল্যাহ অর্থাৎ মোমেনিনের কলব হলো আল্লাহর আরশ। তাইতো সাঁইজি বলেছেন- “মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষের সনে” বা “আপন ঘরের খবর নে-না, অনায়াসে দেখতে পাবি কোনখানে সাঁইয়ের বারামখানা”।

সাইঁজি আল্লাহ-নবি-হরি-যীশু-প্রশান্তির যেমন বাণী আছে আবার তিনি চেয়েছেন সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হোক। মিথ্যার ঘোর থেকে মানুষ মুক্তি পাক। দুনিয়ার সমাজ থেকে ভণ্ডামি ও শয়তানি দূর হয়ে যাক পৃথিবী শান্তিতে ভরে থাক। সুন্দর একটি সমাজ সৃষ্টি হোক মানুষ স্বস্তি পাক। মানুষ নিজের কাছে বড্ড অচেনা। বাহিরের মানুষ আর ভিতরের মানুষ এক হোক। মানুষের এপার-ওপার, জন্ম-মৃত্যু নিয়ে নিরন্তর সত্য নিয়ে শব্দমালা সৃষ্টি করে তাতে সুর-যোজন করেছেন। সাঁইজির ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভ যথা- সত্য কথা, সৎকর্ম করা, সৎ উদ্দেশ্য, মানুষকে ভালোবাসা ও জীবের প্রতি সদয় হওয়া। সাঁইজি ছিলেন মানবাত্মার মুক্তি কাণ্ডারি। সাঁইজি ১৭ অক্টোবর ১৮৯০ খ্রিঃ শুক্রবার ভোর রাতে “ক্ষম ক্ষম ক্ষম মোর অপরাধ” এ বাণী বলতে বলতে দেহত্যাগ করেন। এই অল্প সময়ের জন্য জীবনে সবাই সুখি হোক আমাদের অন্তরে গেঁথে রাখি এবং জীবনে এর প্রতিফলন ঘটাই ...

“সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন, সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দর্শন”

তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ- ফকির এম রেজাউল করিম,: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, লালন একাডেমী রংপুর।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.