পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত বিস্ময়মানব লালন ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ্, মহাত্মা লালন ইত্যাদি নামেও পরিচিত। তাঁকে মরমি সাধক এবং বাউল সম্রাট ফকিরও বলা হয়ে থাকে। একাধারে তিনি একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক । লালন ছিলেন নিঃসন্তান।
আর্থিক অসঙ্গতির কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে না পারলেও তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। যৌবনকালে পূণ্য লাভের জন্য তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়ে তার যৌবনের রূপান্তর ও সাধন জীবনে প্রবেশের ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। তীর্থকালে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে সঙ্গীরা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। পরে একজন মুসলমানের দয়া ও আশ্রয়ে জীবন ফিরে পাওয়ার পর তিনি সাধক ফকির হন।
লালন মুখে মুখেই গানের পদ রচনা করতেন। তাঁর মনে নতুন গান উদয় হলে তিনি শিষ্যদের ডেকে বলতেন- “পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে”। লালন গেয়ে শোনাতেন, ফকির মানিক ও মনিরুদ্দিন শাহ সেই বাধা গান লিখে নিতেন। লালনের জীবদ্দশাতেই তাঁর গান বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। লালনের শিষ্যদের ধারণা তাঁর গানের সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশি। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এত বিপুলসংখ্যক গান পাওয়া যায় না।
শোনা যায় লালনের কোনো কোনো শিষ্যের মৃত্যুর পর গানের খাতা তাদের কবরে পুঁতে দেয়া হয়। এ ছাড়াও অনেক ভক্ত গানের খাতা নিয়ে গিয়ে আর ফেরত দেননি। লালনের গানের অমীয় বাণী, লালনের চিন্তা-দর্শন ও উপলব্ধি আজকের সময়ের জন্য মানুষকে মানবিক করার ক্ষেত্রে এবং আলোকিত পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য অনিবার্য। লালন সাঁই সমাজের সকল শ্রেণি ও ধর্মের মানুষকে আমৃত্যু এক করে দেখেছেন।
লালন সাঁইজি তাঁর জীবদ্দশায় ফাল্গুন মাসের দোল পূর্ণিমার রাতে শিষ্যদের নিয়ে ছেঁড়িয়ার কালীগঙ্গা নদীর তীরবর্তী খোলা মাঠে সারারাত ধরে তত্ত্ব-কথা আলোচনা ও গান-বাজনা করতেন। মরমি সাধক ও বাউল সম্রাট দৌল পূর্ণিমার অবারিত জোছনা গায়ে মেখে রাতভর তত্ত্বকথা, আলোচনা ও গান-বাজনা করতেন। মৃত্যুর পরও সাঁইজির শিষ্য-ভক্তরা এই মাঠে তাঁর স্মরণে দৌল পূর্ণিমার অববাহিকায় আয়োজন করে বর্ণাঢ্য লালন উৎসব।
অচিনপুর থেকে কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়াস্থ এই কালীগঙ্গার স্রোতেই ভেসে এসেছিলেন বাউল ফকির লালন সাঁই। প্রচার করেছিলেন জীবনতত্ত্বের অমৃত ভাববাণী। গড়ে তুলেছিলেন মানব প্রেমের অবিচ্ছেদ্য এক আখড়া। কালের বিবর্তনে প্রস্ফুটিত কালীগঙ্গা আজ সংকুচিত হলেও বিকশিত হয়েছে স্রোতে ভেসে আসা সেই লালনের পরম্পরা।
১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর লালন সাঁই কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ছেঁউড়িয়া গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। লালন সাঁইয়ের ভক্ত মলম শাহের দানকৃত ১৬ বিঘা জমিতে ১৮২৩ সালে লালন আখড়া গড়ে উঠেছিল। প্রথমে সেখানে লালনের বসবাস ও সাধনার জন্য বড় খড়ের ঘর তৈরি করা হয়েছিল।
সাঁইজির সুরে স্নাত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা বাঙালির চিরদিনের এবং চিরকালের। লালনের সুরের সমুদ্রে অবগাহন করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার এক প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা সারাদেশের সমগ্র বাঙালির মাঝেই বিদ্যমান। বাণী আর সুরের নিবিড় বন্ধনে লালন সাঁই সবসময় যে মানুষ ও মানবতার মুক্তির কথা বলে গেছেন এই বিষয়টি স্পষ্টই ফুটে উঠে সাঁইজির গানের পরতে পরতে। লালনের বাণী তত্ত্ব ও দর্শন উপলব্ধির মধ্য দিয়ে আজকের মানুষ ও সমাজ হয়ে উঠতে পারে আরো মানবিক এবং শান্তিময়।