স্যাটেলাইট হলো মহাকাশে উৎক্ষেপিত বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবিত উপগ্রহ। স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার খবর আমরা নিমিষেই পেয়ে যাই। স্যাটেলাইটকে রকেট বা স্পেস শাটলের কার্গো বে-এর মাধ্যমে কক্ষপথে পাঠানো হয়। পাঠানোর সময় রকেট নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হয় ইনার্শিয়াল গাইডেন্স সিস্টেম (আইজিএস) মেকানিজম। পৃথিবীর অভিকর্ষ পার হতে রকেটকে ঘণ্টায় ২৫ হাজার ৩৯ মাইল ত্বরণে ছুটতে হয়।
স্যাটেলাইট স্থাপনের সময় কক্ষীয় গতি ও তার জড়তার ওপর পৃথিবীর অভিকর্ষের যে প্রভাব রয়েছে, এর জন্য সামঞ্জস্য বিধান করতে না পারলে স্যাটেলাইট এ অভিকর্ষের টানে ফের ভূপৃষ্ঠে চলে আসতে পারে। এ জন্য স্যাটেলাইটকে ১৫০ মাইল উচ্চতাবিশিষ্ট কক্ষপথে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১৭ হাজার মাইল গতিতে পরিভ্রমণ করানো হয়। মূলত গতিবেগ কত হবে, তা নির্ভর করে স্যাটেলাইটটি পৃথিবী থেকে কত উচ্চতায় রয়েছে, তার ওপর। পৃথিবী থেকে ২২ হাজার ২২৩ মাইল উপরে স্থাপিত স্যাটেলাইট ঘণ্টায় ৭০০ মাইল বেগে পৃথিবীকে আবর্তন করে। পৃথিবীর সঙ্গে স্যাটেলাইটও ২৪ ঘণ্টা ঘোরে। তবে ভূ-স্থির বা জিওস্টেশনারি উপগ্রহগুলো এক জায়গাতেই থাকে।
এগুলো আবহাওয়া ও যোগাযোগ সংক্রান্ত কাজে ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীর কক্ষপথে স্যাটেলাইট উপবৃত্তাকার পথে ঘোরে। সাধারণত ৮০-১ হাজার ২০০ মাইল উচ্চতাবিশিষ্ট কক্ষপথে বিভিন্ন ধরনের স্যাটেলাইট পাঠানো হয়। কাজের ধরনের ওপর নির্ভর করে স্যাটেলাইটটি কত উচ্চতায় বসবে। যেমন উদ্ভিদ ও প্রাণী নিয়ে গবেষণা, বণ্যপ্রাণীর চরে বেড়ানো পর্যক্ষেণ, অ্যাস্ট্রোনমি এবং পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করার জন্য সায়েন্স স্যাটেলাইটকে বসানো হয় ৩০ হাজার থেকে ৬ হাজার মাইল উচ্চতায়। আবার গোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয় ৬ হাজার থেকে ১২ হাজার মাইল উচ্চতায়। এক এক ধরনের স্যাটেলাইটের বৈশিষ্ট্য ও গঠন প্রণালী একেকরকম। তবে সব স্যাটেলাইটের মধ্যেই সাধারণত কিছু মিল আছে।
স্যাটেলাইটের শরীর ধাতু সংকরের ফ্রেম দিয়ে তৈরি। একে বলে বাস। এতেই স্যাটেলাইটের সব যন্ত্রপাতি থাকে। প্রত্যেক স্যাটেলাইটে থাকে সোলার সেল এবং শক্তি জমা রাখার জন্য ব্যাটারি। এর পাওয়ার সিস্টেম প্রসেসকে পৃথিবী থেকে সবসময় মনিটর করা হয়। স্যাটেলাইটে একটি অনবোর্ড কম্পিউটার থাকে যা একে নিয়ন্ত্রণ এবং বিভিন্ন সিস্টেমকে মনিটর করে। স্যাটেলাইটের আরেকটি মৌলিক বৈশিষ্ট হল এর রেডিও সিস্টেম ও অ্যান্টেনা।
স্যাটালাইটের ইতিহাস
কৃত্রিম উপগ্রহ ও মহাকাশ যাত্রার ইতিহাস খুব একটা পুরনো নয়, একেবারেই নতুন। আপনারা জেনে অবাক হবেন যে, মহাকাশ যাত্রার প্রথম পদক্ষেপটির সূচনা হয়েছিল ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর। এই যাত্রার সূচনা করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারা স্পুটনিক-১ নামক কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করে। স্পুটনিক শব্দের অর্থ হলো ভ্রমণসঙ্গী। একই বছর ২ নভেম্বর স্পুটনিক-২ নামক আরেকটি কৃত্রিম উপগ্রহ তারা মহাকাশে পাঠান। প্রথম মার্কিন কৃত্রিম উপগ্রহের নাম এক্সপ্লোরার-১। এই উপগ্রহ ১৯৫৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মহাকাশে পাঠানো হয়। ভস্টক-১ নামক সোভিয়েত কৃত্রিম উপগ্রহ মানুষ নিয়ে প্রথম পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। যে মানুষটি প্রথম মহাকাশে গিয়েছিলেন ইউরি গ্যাগারিন। তিনি ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিক। তিনি ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল ভস্টক-১ এ চড়ে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেন। স্টক-৬ নামক কৃত্রিম উপগ্রহে চড়ে প্রথম সোভিয়েত মহিলা মহাকাসচারি ভেলেন্তিনা তেরেসকোভা মহাকাশে ঘুরে আসেন ১৯৬৩ সালে। ইনটেলসেট-১ কৃত্রিম উপগ্রহকে পাঠানো হয় বাণিজিয়কভাবে ব্যবহারের জন্য যোগাযোগ উপগ্রহ হিসেবে। রিমোটসেনসিং বা দূর অনুধাবনের জন্য পাঠানো প্রথম উপগ্রহ হলো ল্যান্ডসেট-১। একে পাঠানো হয় ১৯৭২ সালে। আন্তর্জাতিক যোগসূত্র স্থাপনের জন্য অ্যাপোলো-সয়োজ টেস্ট প্রজেক্ট নামে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে প্রথম পাঠানো হয় ১৯৭৫ সালে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এ পর্যন্ত প্রায় সহস্রাধিক কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে পাঠিয়েছে। কয়েক শত কৃত্রিম উপগ্রহ বর্তমানে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং হাজার হাজার অব্যবহৃত কৃত্রিম উপগ্রহ বা তাদের অংশবিশেষ মহাকাশে ধ্বংসাবশেষ হিসেবে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে।
স্যাটেলাইট এর কক্ষপথঃ
মহাকাশে স্যাটেলাইটগুলো যে ডিম্বাকার পথে ঘুরতে থাকে সেই পথকে বলা হয় অরবিট বা কক্ষপথ। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা অনুসারে এই অরবিটকে তিনভাগে ভাগ করা যায় । ১. নিম্ন কক্ষপথ, ভূ-পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ১২৪০ মাইল বা ২,০০০ কিলোমিটার। ২. মধ্য কক্ষপথ, ভূ-পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ২,০০০ কি.মি থেকে ৩৫,৭৮৬ কি.মি পর্যন্ত। ৩. উচ্চ কক্ষপথ, ভূ-পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৩৫,৭৮৬ কি.মি. থেকে অসীম।
স্যাটেলাইটের প্রকারভেদঃ
প্রত্যেকটি স্যাটেলাইট ডিজাইন করা হয় ফর অ্যা স্পেসিফিক টাস্ক। নির্দিষ্ট কাজের ভিত্তিতে স্যাটেলাইটগুলোকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়।
ওয়েদার স্যাটেলাইট:
এই স্যাটেলাইট আবহাওয়া পর্যবেক্ষনের কাজে ব্যবহার করা হয়। এ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পৃথিবীর আবহাওয়া সংক্রান্ত ফটো ধারন করা হয়। যেমন TIROS, COSMOS এবং GEOS স্যাটেলাইট।
কম্যুনিকেশন স্যাটেলাইট:
কম্যুনিকেশন স্যাটেলাইট হল সিগন্যাল বা তথ্যের আদান প্রদান হয় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। ব্রডকাস্টিং স্যাটেলাইটও এর অন্তর্ভূক্ত। এই কম্যুনিকেশনকে স্পেস কম্যুনিকেশনও বলে। এই স্যাটেলাইটে একটি অ্যান্টেনা সিস্টেম, একটি ট্রান্সমিটার তথা প্রেরক যন্ত্র, পাওয়ার সাপ্লাই ও রিসিভার তথা গ্রাহক যন্ত্র থাকে। এই সিস্টেমে আর্থ স্টেশন ট্রান্সমিটার থেকে মডুলেটেড মাইক্রোওয়েভ তথা সিগন্যাল+ উচ্চ কম্পাঙ্কের বহনকারী তরঙ্গ পাঠানো হয় স্যাটেলাইটে। স্যাটেলাইট সেই মডুলেটেড ওয়েভকে বিবর্ধিত করে পৃথিবীতে স্থাপিত গ্রাহক স্টেশনে পাঠিয়ে দেয়। জিওস্টেশনারী অরবিটে জিওস্টেশনারী স্যাটেলাইট।
এখন কোন স্যাটেলাইট যদি ৩৫,৭৮৬ কি.মি. উচ্চতায় স্থাপিত হয় তখন স্যাটেলাইটটি পৃথিবীর সাথে সমবেগে আবর্তন করে অর্থাৎ স্যাটেলাইটটি এমনভাবে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে যেন পৃথিবীর চারদিকে এক বার ঘুরতে তার ২৪ ঘন্টা সময় লাগে আর যেহেতু পৃথিবীরও নিজের চারদিকে একবার ঘুরতে ২৪ ঘন্টা সময় লাগে তাই পৃথিবীর সাপেক্ষে স্যাটেলাইটটিকে স্থির মনে হবে। তখন এই ধরনের স্যাটেলাইটকে বলা হয় ভূ-স্থির উপগ্রহ আর এই কক্ষপথকে বলা হয় জিও স্টেশনারী অরবিট বা ভূ-স্থির কক্ষপথ। এই কক্ষপথ কম্যুনিকেশনের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী কিন্তু এই কক্ষপথেরও একটি অসুবিধা আছে তা হলো এই কক্ষপথে স্থাপিত একটি কম্যুনিকেশন স্যাটেলাইট সমগ্র পৃথিবীকে কভার করতে পারে না পৃথিবীর বক্রতার কারনে। সমগ্র পৃথিবীকে কভার করতে হলে এই কক্ষপথে তিনটি স্যাটেলাইট স্থাপন করতে হয়। যদি তিনটিই স্যাটেলাইট পরষ্পর থেকে ১২০ ডিগ্রি কোণে জিও স্টেশনারী অরবিটে অবস্থান করে তাহলে একই সাথে সমগ্র পৃথিবীকে কভার করা সম্ভব।
ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট:
এই স্যাটেলাইট বিমান ও সমুদ্রগামী জাহাজ ডিটেক্ট ও ন্যাভগেট তথা পথ নির্দেশনা করতে ব্যবহার করা হয়। যেমন GPSNAVSTAR স্যাটেলাইট। আর জিপিএস হল স্যাটেলাইট ভিত্তিক নেভিগেশন সিস্টেম । জিপিএস সিস্টেম এমন একটি নেটওয়ার্ক যা ২৪ টি স্যাটেলাইট নিয়ে গঠিত যা নিরবিচ্ছিন্নভাবে তথ্য ও পৃথিবীর কোন অবস্থানের ছবি পাঠাতে সক্ষম যেকোন সময়ে ও যেকোন আবহাওয়ায়।
আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট: এই স্যাটেলাইট পৃথিবী পৃষ্ঠ নিরীক্ষন করতে ও পৃথিবী পৃষ্ঠের বিভিন্ন অংশের ছবি তুলতে ব্যবহার করা হয়।
মিলিটারী স্যাটেলাইট:
এই স্যাটেলাইট শুধুমাত্র সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। এর মুল কাজ হল- নিউক্লিয়ার মনিটরিং, রাডার ইমেজিং, ফটোগ্রাফি ও শত্রুর গতিবিধ পর্যবেক্ষন ।
মহাকাশে স্যাটেলাইটের সংখ্যাঃ
সর্বপ্রথম সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫৭ সালে স্পুটুনিক-পিএস রকেটের সাহায্যে স্পুটুনিক-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে সফলভাবে উৎক্ষেপন করতে সক্ষম হন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্যরাষ্ট্রও পাঠাতে সক্ষম হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০টিরও অধিক দেশ থেকে কয়েকহাজার স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপন করা হয়েছে তবে পৃথিবীর মাত্র ১০ টি দেশ নিজস্ব প্রযুক্তিতে ও নিজস্ব উৎক্ষেপনকেন্দ্র থেকে মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করতে সক্ষম হয়েছে। দেশগুলি হল সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯৫৭), যুক্তরাষ্ট্র(১৯৫৮), ফ্রান্স(১৯৬৫), জাপান(১৯৭০), চীন(১৯৭০), যুক্তরাজ্য(১৯৭১), ভারত(১৯৮০), ইসরায়েল(১৯৮৮), ইউক্রেইন(১৯৯২) ও ইরান(২০০৯)। বর্তমানে মহাকাশে ঘুরনায়মান স্যাটেলাইটের সংখ্যা হল ১০৭১ টি। আর মজার ব্যাপার হল এর ৫০ ভাগ উৎক্ষেপণ করেছে যু্ক্তরাষ্ট।
তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ- ইন্টারনেট এবং স্যামহয়ার ব্লগ