বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

কুষ্টিয়ার কৃতীঃ আগা ইউসুফ
কুষ্টিয়ার কৃতীঃ আগা ইউসুফ

আগা ইউসুফ (জন্মঃ- ১৯২৪ সালের ২৩শে এপ্রিল - মৃত্যুঃ- ২০০৩ সালের ৩০শে এপ্রিল):- ১৯৬০'এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় দুই দশকের মধ্যে তিনি তামাক ও তামাকজাত পণ্য থেকে শুরু করে কৃষি, ব্যাংকিং, স্বাস্থ্যসেবা, ঔষধ শিল্প, ইঞ্জিনিয়ারিং, হিমাগার, পাটশিল্প, টেক্সটাইল, টিম্বার ও প্রকাশনার মতো অন্তত ২০টির মতো শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে চমক লাগিয়ে দেন।

অথচ অবাক ব্যাপার, তাঁর মৃত্যুর পর কয়েক বছর যেতে না যেতেই, আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্যের যে পরিণতি হয়েছিল তেমনি করে 'এরবা গ্রুপ' নামে পরিচিত আগা ইউসুফ সাহেবের শিল্প সাম্রাজ্যেরও পতন ঘটে। অক্ষম উত্তরাধিকারী, অব্যবস্থাপনা, একশ্রেণির সুবিধাবাদী কর্মকর্তার লুটপাট, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির ঋণের অর্থ ও পাওনা পরিশোধ না করা ইত্যাদি কারণে একে একে সবগুলি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে থাকে, যে ক'টি এখনো হয়নি সেগুলিও হওয়ার পথে।

এবার আসুন অতীতের দিকে ফিরে দেখা যাক। আগা ইউসুফ সাহেবের জন্ম ১৯২৪ সালের ২৩শে এপ্রিল, কুষ্টিয়া শহরের অদূরে বারখাদা গ্রামে। এখানেই তাঁর পিতৃ ও মাতৃকুলের আদি নিবাস। তার পিতা শেখ ইউসুফ আলী ছিলেন ব্রিটিশ আমলে সাব- রেজিস্ট্রার, পরে ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার হিসাবে অবসরগ্রহণ করেন। মা সালেমা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। আগা ইউসুফ ছিলেন মা-বাবার পাঁচ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। তাঁর পুরো নাম আবু মুহাম্মদ আগা ইউসুফ। ('আগা' হচ্ছে তুর্কি সুলতানদের আমলে অভিজাতবংশীয়দের দেওয়া সম্মানসূচক খেতাব বা সম্ভাষণ)। তাঁর অন্য ভাই-বোন হচ্ছেন বড়বোন সালেহা খাতুন (যিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত ছিলেন), আসিয়া খাতুন (গৃহিণী) এবং ছোট দুই ভাই আবু মুহাম্মদ হাসান ইউসুফ ও আবু মুহাম্মদ আনোয়ার ইউসুফ। এঁরা দু' জন মূলত আগা ইউসুফের ব্যবসায় - বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

আগা ইউসুফ কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন এবং ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি কিছুদিন সেখানে আইন বিষয়েও অধ্যয়ন করেন। এরমধ্যে সাতচল্লিশের দেশ বিভাগ হয়ে গেলে তিনি কুষ্টিয়ায় ফিরে আসেন এবং সেনাবাহিনীতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন।

তিনি পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন এবং সেখান থেকে কমিশন লাভ করেন। সেনাবাহিনীতে তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে এক পর্যায়ে মেজর পদে উন্নীত হন। এই একই পদে দীর্ঘ সময় থাকাকালে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনসহ সকল ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানি তথা বাঙালিদের প্রতি বৈষম্যের বিষয়টি তাঁর কাছে বড় হয়ে ধরা পড়ে। তিনি লক্ষ্য করেন সকল যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাঁর পদোন্নতি হচ্ছে না অথচ তাঁর পাঞ্জাবি ও পাঠান জুনিয়ররা তাঁকে ডিঙ্গিয়ে যাচ্ছে। তিনি একপর্যায়ে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ওই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেঃ জেনারেল হাবিবউল্লাহ খান পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন কর্পোরেশন PIDC 'র চেয়ারম্যানের দায়িত্বপালন করছিলেন।

আগা ইউসুফ স্বেচ্ছায় অবসর নিচ্ছেন জানতে পেরে হাবিবউল্লাহ খান তাঁকে বাড়িতে বসে না থেকে PIDC' তে যোগদানের পরামর্শ দিলেন । (উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বেয়াই ও গওহর আইয়ুবের শ্বশুর এই হাবিবউল্লাহ খান পরবর্তীতে পাকিস্তানের শীর্ষ শিল্পপতিদের একজন হয়েছিলেন)। ১৯৬০ কিংবা '৬১ সালের প্রথম দিকে আগা ইউসুফ তাঁরই পরামর্শে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন কর্পোরেশন বা EPIDC' র প্রথমে স্পেশাল অফিসার ও পরে সেক্রেটারি পদে যোগদান করেন ( PIDC তখন ভাগ হয়ে গেছে )। এ সময় অনেকটা তাঁর চেষ্টায় কুষ্টিয়া চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে তিনি একপর্যায়ে তাঁর 'গুরু' বা mentor হাবিবউল্লাহ খানের পথ অনুসরণ করে নিজেও একজন শিল্প উদ্যোক্তা হওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে চাকরি ছেড়ে দেন এবং যশোরের সিঙ্গিয়ায় আলফা টোব্যাকো কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন ( ১৯৬৬)। এই আলফা-ই ছিল তাঁর সাফল্যের প্রথম সোপান। এরই পথ ধরে একে একে অনেকগুলি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে শুরু থেকেই আগা ইউসুফ সাহেবের দুই ভাই হাসান ইউসুফ ও আনোয়ার ইউসুফ তাঁর প্রধান সহযোগী ছিলেন। পরের দিকে হাসান ইউসুফ অসুস্থতার কারণে কিছুটা সরে থাকলেও আনোয়ার ইউসুফ সেই ছাত্রাবস্থা থেকেই বড়ভাইয়ের ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে তাঁর প্রধান সহায়কের ভূমিকা পালন করেন। তবে কী এক রহস্যজনক পরিস্থিতিতে আনোয়ার ইউসুফ ঢাকায় তাঁদের অফিস ভবনের চৌদ্দতলা থেকে পড়ে মারা যান তা কেউ জানে না। তারিখটি ছিল ১৯৯৭ সালের ১৬ই মার্চ। বলা হয়ে থাকে জনাব আনোয়ার তাঁর অফিস কক্ষ সংলগ্ন ওয়াশরুমের ভেন্টিলেটরের ভিতর দিয়ে নিচে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু ঘটনার পর অকুস্থল পরিদর্শন করেন তাদের বক্তব্য - ভেন্টিলেটরের ওই সামান্য ফাঁক দিয়ে আনোয়ার ইউসুফের মতো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পক্ষে লাফিয়ে পড়া ছিল নিতান্তই অসম্ভব ব্যাপার। উপরন্তু আত্মহত্যা করে মৃত্যুকে ডেকে নেয়ার মতো কোনো ঘটনাও আনোয়ার সাহেবের জীবনে ঘটেনি, তেমন কোনো পরিস্থিতিও ছিল না। তবু পুলিশের তদন্তে রহস্যের কোনো কিনারা হয়নি, কেবল গুজবের ডালপালা মেলেই বিষয়টির সমাপ্তি ঘটেছে। যারা এই আত্মহত্যার বিষয়টিকে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও পারিবারিক কলহের চূড়ান্ত পরিণতি বলে মত প্রকাশ করেছিলেন তারাও বেশিদূর অগ্রসর হননি। তবে আনোয়ার ইউসুফের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই যে আগা ইউসুফের শিল্প সাম্রাজ্যের পতনের প্রথম সিঁড়িটি নির্মিত হয়েছিল সে কথা এখনো অনেকেই বিশ্বাস করেন।

জনাব আগা ইউসুফ নানাবিধ কল- কারখানা স্থাপনের পাশাপাশি বেশকিছু জনহিতকর ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি জন্মস্থান বারখাদা গ্রামে প্রয়াত পিতার নামে ইউসুফ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গঠন করেন। এই ট্রাস্টের অধীন একটি চক্ষু হাসপাতাল, এতিমখানা, মসজিদ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তিপ্রদান ও এসবের ব্যয় নির্বাহে সহায়তার জন্য শহরে একটি সুপারমার্কেট স্থাপন করা হয়।

জনাব আগা ইউসুফ ১৯৫১ সালে বেগম বদরুন-নাহারকে বিয়ে করেন। তাঁদের বিয়ে সুখের হয়েছিল এবং বেগম নাহার স্বামীর কর্মপ্রচেষ্টায় সর্বদা উৎসাহ জুগিয়েছেন। তাঁদের দুই পুত্র আর দুই কন্যা, এদের ডাকনামগুলি যথাক্রমে নয়ন, নন্দন, নোরা ও ফ্লোরা। দ্বিতীয় পুত্র নন্দন লন্ডনে বাস করতেন, সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আগা ইউসুফ সাহেবের স্ত্রী বদরুন নাহার ঢাকায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ২০০৩ সালের ১০ই এপ্রিল। এর মাত্র ২০ দিন পর একই বছর ৩০শে এপ্রিল আগা ইউসুফ ইন্তেকাল করেন। এঁরা দু'জনই শেষদিকে অসুস্থ ছিলেন। দুইজনের মরদেহই কুষ্টিয়ায় এনে বারখাদা গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

Add comment

কুষ্টিয়া সম্পর্কিত তথ্য

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন