জালাল উদ্দীন খাঁ (১৮৯৪-১৯৭২) পূর্ব ময়মনসিংহের একজন বিশিষ্ট বাউল কবি ও গায়ক। তাঁর জন্ম নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার আসদহাটি গ্রামে। তাঁর পিতার নাম সদরুদ্দীন খাঁ।
বিশ শতকের বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে প্রাকৃত বাঙালিজনের এই কবি তাঁর সাধনায় সক্রিয় ছিলেন। যে অঞ্চলে তিনি জন্মেছিলেন ও জীবন-যাপন করেছিলেন, সে অঞ্চলটির লৌকিক ঐতিহ্য খুবই সমৃদ্ধ। তখনকার অখণ্ড বাংলার বৃহত্তম জেলা ময়মনসিংহের যে অংশটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘পূর্ব ময়মনসিংহ’ নামে, জালালউদ্দীন খা সেখানকারই মানুষ। এককালের পূর্ব ময়মনসিংহের নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও তার আশপাশের সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের কিছু অংশ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী প্রভৃতি এলাকা নিয়েই গড়ে উঠেছিল একটি বিশিষ্ট সংস্কৃতি অঞ্চল। সে অঞ্চলে জন্ম হয়েছিল অনেক লোককবি ও লোকগীতিকাব্যের। এরকমই লোককবি ও লোকগীতিকার সুনামগঞ্জের হাছন রাজা,আব্দুল করিম ও রাধারমন, নরসিংদীর দ্বিজদাস ও হরিচরণ আচার্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মনোমোহন দত্ত, নেত্রকোনার লাল মাসুদ, সুলা গাইন, বিজয় নারায়ণ আচার্য, দীন শরৎ (শরৎ চন্দ্র নাথ), কিশোরগঞ্জের রামু মালি, রামগতি শীল ও রামকানাই নাথ। এঁদেরই প্রত্যক্ষ উত্তরসাধক বিশ শতকের জালালউদ্দীন খাঁ।
বৈষ্ণবপদাবলী, শাক্তপদাবলী, সহজিয়া পদাবলী এবং বাউল সুরের বিভিন্ন গান তাঁর সঙ্গীত চর্চায় প্রভাব বিস্তার করলেও নিজস্ব চিন্তাধারায় রাগ রাগিনীর মৌলিকতায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী সঙ্গীত রচনায় তাঁর বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। তাঁর রচিত সঙ্গীত তথা শব্দ বিন্যাস উপমা অলংকারণের নৈপূর্ণ্য নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। বর্তমানে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে যে ধারার গীতি- সাধনা প্রবাহমান এর মূল ধারক জালাল উদ্দীন খাঁ একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। জালাল উদ্দীন খাঁ রচিত জালাল গীতিকা পাঁচ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া “বিশ্ব রহস্য” নামে একটি নিগুঢ় তথ্য সমৃদ্ধ পুস্তক তিনি প্রকাশ করেন। তাঁর রচিত গান গুলোকে বাউল ধারায় মারফতি, মূর্শিদী, ভাটিয়ালী ব্যতিত, পরমতত্ত্ব , নিগূঢ়, দেহতত্ত্ব , সৃষ্টিতত্ত্ব, সংসারতত্ত্ব , সাধনতত্ত্ব , প্রেমতত্ত্ব , বিরহতত্ত্ব , মাতৃতত্ত্ব , লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব শ্রেণীতে বিন্যাস করেছেন।
জালাল উদ্দীন খাঁ সম্পর্কে জালাল গীতিকা সমগ্র গ্রন্থে অধ্যাপক যতীন সরকার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। জালাল উদ্দীন খাঁ একাধারে কবি, বাউল গায়ক, সুরকার, গীতিকার ও প্রবন্ধকার। তিনি সকল ক্ষেত্রে নিজস্ব ভঙ্গি ও স্বার রেখেছিলেন। লোকায়ত ধর্মের মর্মসন্ধানী এই মানুষটি লোক জীবনের সব কিছুর সঙ্গেই নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। জালাল খাঁর যাপিত জীবন ও জীবন দর্শনে কোন অনৈক্য বা বৈপরীত্য ছিল না। তাঁর কবিতা চর্চা ততা সঙ্গীত সাধনাও ছিল তাঁর যাপিত জীবন ও জীবন দর্শন একই সূত্রে গাথা। আর এসবের সঙ্গে জড়িত মিশ্রিত ছিল লোকায়ত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। সেই উত্তরাধিকারের কেবল ভারবাহী ছিলেন না তিনি। কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের নির্বিচার ভোগেই জীবন কাটিয়ে দেন নি। সময় ও পরিপার্শ সম্পর্কে সচেতন এই মানুষটি ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারকে আপন সময় ও পরিপার্শ উপযোগী করে নেওয়া প্রয়োজন সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। সেই অবহিতির পরিচয়ই তাঁর রচনার পরতে পরতে ধরা পড়েছে।
একজন প্রকৃত আধুনিক মানুষের মতোই তিনি লক্ষ করেছেন যে ধর্মব্যবসায়ীরা জনসাধারণের আত্মজ্ঞান লাভের পথে বাধার সৃষ্টি করে রেখেছে, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে ভাষা শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত রাখতে চেয়েছে। তাইতো তিনি বলেছেন, ‘বিজাতি ইংরেজি শিক্ষায় বেহেশ্ত না পাওয়া যায় মোল্লাজিদের কথা শুনে শিখল না মানুষে, সকল ভাষা সমান বুঝে ধর এবার কষে- কবে আবার সুদিন উদয় জালালে কয় চল্ সাহসে । যেসময়ে পল্লির মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণকে পাপ বলে মনে করেছে, সে সময়েই জালাল বলেছেন, ‘জন্মনিরোধ না করিলে সুখ পাবে না এ-সংসারে।’ শুধু গ্রাম-গঞ্জের অজ্ঞাত-অখ্যাত গায়কদের কণ্ঠেই নয়, আব্বাস উদ্দিন ও আবদুল আলিমের মতো প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পীও জালালের গান রেকর্ড করেছেন। সে রকমই কয়েকটি গান হলো- ‘ও আমার দরদি আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না’, ‘আরেও ভাইট্যাল গাঙের নাইয়া’, ‘দয়াল মুর্শিদের বাজারে’, ‘সেই পাড়ে তোর বসত বাড়ি’ এসব গান অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করলেও এগুলোর রচয়িতা যে জালাল উদ্দীন খাঁ এই প্রয়োজনীয় তথ্যটি অনেকেরই অজ্ঞাত। শুধু আত্মতত্ত্ব কিংবা পরমতত্ত্ব নয়, জালালের গানে স্বদেশপ্রেমের অভিব্যক্তিও ঘটেছে- ‘জীবন আমার ধন্য যে হায় জনম মাগো তোমার কোলে স্বর্গ যদি থেকেই থাকে/বাংলা মা তোর চরণ মূলে’, ‘হেথা আমি কুসুম সাথে জনম নিলাম অরুণ প্রাতে/শুয়ে ঘাসের গালিচাতে মরণ যেন হয় বিভোলে। মরার পরে ভুল ভাঙ্গিয়া তোমার মনে মিশাইয়া রেখ আমায় যুগে যুগে জালালে কয় পরাণ খুলে।’ গেল শতাব্দীর শেষভাগে জালাল উদ্দীন খাঁর জীবন ও সংগীত নিয়ে গবেষণা শুরু করেন বেশকিছু গুণীজন। ১৯৯০ সনে বাংলা একডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছে আজিজুল হক চৌধুরী’র জীবনীগ্রন্থ ‘জালাল উদ্দীন খাঁ’।
অন্যদিকে পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত গবেষক সুধীর চক্রবর্তী ১৯৯০ সনে ‘বাংলা দেহতত্ত্বের গান’ ও ২০০১ সনে ‘জনপদাবলি’ নামে দুটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। প্রথম গ্রন্থটিতে জালালের ১০টি ও দ্বিতীয় গ্রন্থটিতে তার ১৩টি গান সংকলিত হয়েছে। দুটো গ্রন্থের ভূমিকাতেই জালালের সংগীত সম্পর্কে তিনি আলোচনা করেছেন। সুধীর চক্রবর্তীর ‘জালাল-গীতি: ‘কত রঙের নকশি কাঁথা’ নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে নাঈম হাসান-সম্পাদিত লিট্ল ম্যাগাজিন ‘নিরন্তর’-এর ষষ্ঠ সংখ্যায় পৌষ, ১৪১২ সালে। এছাড়া যতীন সরকার সম্পাদিত ‘জালালগীতিকা সমগ্র’ একটি দুর্লভ প্রকাশনা। লোকমানুষের মরমি এই শিল্পী ১৯৭২ সালে তার সাধনার আত্মতত্ত্ব থেকে স্পর্শ করেন পরমতত্ত্বে।
আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব ও বিরহতত্ত্বের নামাঙ্কিতের মাঝে জালাল উদ্দিন প্রায় সহস্রাধিক গান রচনা করেছিলেন। প্রখ্যাত এই লোক কবি মালজোড়া গানের আসরেও ছিলেন অনন্য। জালাল উদ্দীন খাঁ অনেক গান রচনা করেছিলেন। তার জীবদ্দশায় চার খণ্ডের ‘জালাল-গীতিকা’ গ্রন্থে ৬৩০টি গান প্রকাশিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘জালাল-গীতিকা’ পঞ্চম খণ্ড। সেই খণ্ডে গানের সংখ্যা ৭২টি। এই মোট ৭০২টি গান নিয়ে ২০০৫ সালের মার্চে প্রকাশিত হয়েছে ‘জালাল গীতিকা সমগ্র।’ জালাল তার গানগুলোকে বিভিন্ন ‘তত্ত্ব’তে বিন্যস্ত করে প্রকাশ করেন। সেই তত্ত্বগুলোর নামগুলো হলো- আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ় তত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব, বিরহতত্ত্ব। ‘জালালগীতিকা’র অধিকাংশ গানই এরকম তত্ত্বনামাঙ্কিত হলেও অনেক গানকে জালাল খাঁ তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত করেননি। যেমন- ‘জালাল গীতিকা’ প্রথম খণ্ডে সংকলিত ২০২টি গানের মধ্যে ২০টি গান ‘ভাটিয়ালি’ নামাঙ্কিত। দ্বিতীয় খণ্ডের ২২৮টি গানের ৬০টিই ‘ভাটিয়ালি’। তৃতীয় খণ্ডের ৭৮টি গানের সাতটি ‘তত্ত্ব’ বিষয়ে, আর ১৪টি ‘মুর্শিদি’ ও ১১টি ‘মারফতি’ নামাঙ্কিত গান। ‘জালাল গীতিকা’র চতুর্থ খণ্ডে কোনো তত্ত্ব নির্দেশ ছাড়াই বাউল সুর, ঝাপতাল, চৌপদী, প্রসাদ সুর, মুকুন্দ সুর, খেমটা নামে মোট ১০১টি গান সংকলিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর উত্তরসূরিদের হতে ‘জালাল গীতিকা’র যে পঞ্চম খণ্ড প্রকাশিত হয় তাতে গীতিগুলোর কোনোরূপ শ্রেণীবিন্যাস বা নামাঙ্কন করা হয়নি। নব এই প্রকাশনায় জালালের জীবৎকালে অপ্রকাশিত বিভিন্ন ধরনের ৭২টি গীতি সংকলন করা হয়। তাছাড়া " বিশ্ব রহস্য " নামে একটি প্রবন্ধ গ্রন্হ প্রকাশ করেন। ১৯৭২ সনে ৩১ জুলাই বাংলা ১৬ই শ্রাবণ, ১৩৭৯ দুই পুত্র তিন কন্যা, এবং স্ত্রী শামছুন্নাহার বেগমকে রেখে দেহত্যাগ করেন। নিজ গ্রামের বাড়ীর আঙ্গিনায় তার মাজার অবস্থিত। প্রয়াত মরমী বাউল সাধক জালাল উদ্দিন খাঁ স্মরণে প্রতি বছর দু’দিন ব্যাপী পালিত হয় জালাল মেলা।