শাহ্ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (জন্ম: অজ্ঞাত - মৃত্যু ১০৫৩ খ্রীঃ) একজন সুফি দরবেশ। নেত্রকোণা সদর উপজেলার মদনপুর নামক স্থানে শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমীর সমাধি রয়েছে। ১০৫৩ খ্রীস্টাব্দের কিছু পূর্বে পশ্চিম এশিয়ার তুরস্কের সেলজুক রাজ্য থেকে সুফী সাধক শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী(রহঃ)-র আগমন বলে কথিত আছে।
আরো কথিত আছে রোম সম্রাজ্য বিজয়ী তুরস্ক রাজ্যকেই রোম সম্রাজ্য বলা হতে। এর শাসককে বলা হতো রুমী এবং সে রাজ্যের সুলতানের ছোট ভাই হিসেবে শাহ সুলতানও রুমী উপাধিতে অভিহিত করা হতো।
১২০ জন সুফী সাধকের একটি দল নিয়ে প্রথমে বর্তমান বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল চট্টগ্রাম অঞ্চলে তিনি আসেন। সেখান থেকে পণ্ড্রয়ার রাজধানী মহাস্থান গড় (বগুড়া) অভিমুখে ধর্ম প্রচার্থে যাত্রা করেন। ইতোপূর্বেই ১২০ জনের সুফীদলের একাংশ নিয়ে শাহ্ সুলতান সৈয়দ মাহমুদ মাহিসাওয়ার বলখী মহাস্থানে পৌঁছে সেখানকার শাসক পরশুরাম কে ইসলামের দাওয়াত দেন। এতে পরশুরাম ক্ষিপ্ত হয়ে শাহ্ সুলতান সৈয়দ মাহমুদ মাহিসাওয়ার বলখী দলকে আক্রমন করেন। সে আক্রমনে শাহ্ সুলতান সৈয়দ মাহমুদ মাহিসাওয়ার বলখী ৭(সাত) জন শহীদ হন। শাহ্ সুলতান সৈয়দ মাহমুদ মাহিসাওয়ার বলখী এর শহীদ হওয়ার সংবাদে শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী তাঁর কায়কাউয়ার নামক সুফীদের সংঘবদ্ধ দলকে নিয়ে মহাস্থানে গমন করেন। তিনি সরাসরি পরশুরামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে আল্লাহর একাত্মবাদ ও তার প্রেরীত পুরুষ হযরত মোহাম্মদ (দঃ) কে মেনে ইসলাম ধর্ম গ্রহনের প্রস্তাব দেন। এ প্রস্তাবে পরশুরাম পুনরায় ক্ষিপ্ত হলে শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী তাঁকে আক্রমন করেন। এতে পরশুরাম নিহত হয়েছিল।
পরশুরামকে পরাস্থ করে শাহ্ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী বরেন্দ্র ভূমি হস্তগত করে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। সেখান থেকে পূর্বদিকে যমুনানদী পাড়ি দিয়ে দুর্মুট নামক স্থানে গমন করেন (স্থানটি বর্তমান জামালপুর জেলাধীন) এবং সেখানে আস্তানা স্থাপন করেন। সেখান থেকে ব্রহ্মপুত্র নদী অতিক্রম করে বোকাই কোচের রাজ্য বোকাইনগর গমন করেন। সেখানে বোকাই কোচকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষাদেন। পরে বোকাইনগরের পূর্বদিকে মদন কোচের রাজ্য মদনপুরে যান। মদন কোচকে তিনি বুদ্ধি বলে পরাস্থ করে মদনপুরে ইসলাম ধর্ম প্রচারকার্য শুরু করেন।
বাংলায় আগমনকারী সুফি-দরবেশদের মধ্যে শাহ্ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (খ্রি. ১১ শতক) অন্যতম। নেত্রকোনা জেলার মদনপুর ইউনিয়নের মদনপুর উপশহরে তার পবিত্র মাজার অবস্থিত। অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী এ সুফি-দরবেশ ৪৪৫ হিজরি মোতাবেক ১০৫৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলায় আগমন করেন। তার সঙ্গে ১২০ সহচর ও শিষ্য আসেন। শাহ সুলতান রুমি মদনপুর এলাকার তদানীন্তন কোচ-রাজার দরবারে গিয়ে রাজার প্রদত্ত দুষ্পাচ্য মৃত্যু বিষ বিসমিল্লাহ বলে মুখে দিয়ে হাসিমুখে হজম করলে রাজা তার লোকাতীত শক্তি দেখে বিস্মিত হন এবং তার নামে মদনপুরসহ তথাকার এক বৃহত্তর এলাকা যথাবিধি ইজারা পাট্টা লিখে উপহার দেন। ফলে সেখানকার রাজাসহ উপজাতীয় লোকেরা দলে দলে এসে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।
শাহ সুলতানের মাজার রক্ষণাবেক্ষণে যে নিস্কর সম্পত্তি রয়েছে তার স্বীকৃতি ১০৮২ হিজরিতে (১৬৭১ খ্রি.) বাদশাহ শাহজাহানের (১৫৯২-১৬৬৬ খ্রি.) পুত্র বাংলার সুবাদার শাহ সুজা (১৬১৬-১৬৬০ খ্রি.) ফারসি ভাষায় এক সনদ প্রদান করেছিলেন। এই শাহি সনদে তার মুর্শিদসহ ৪৪৫ হিজরিতে (১০৫৩ খ্রি.) মদনপুরে আগমন ও তথাকার কোচ-রাজার দেওয়া বিষ নির্দি্বধায় গলাধঃকরণ এবং রাজা কর্তৃক প্রদত্ত সমগ্র গ্রাম উৎসর্গের ঐতিহাসিক বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। শশীভূষণ দাশগুপ্তের (১৯১১-১৯৬৪ খ্রি.) মতে, সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম সুফি মরমিয়া বাণীবাহকও তিনি। দরবেশ শাহ সুলতান রুমি মদনপুর গ্রামে আস্তানা গাড়েন এবং উক্ত অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। তদানীন্তন কোচ-রাজা তার নিকট ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাকে মদনপুর গ্রামের স্বত্ব দান করেন।
শাহ সুলতান রুমির মাজারের আশপাশে অর্থাৎ মদনপুর এলাকার বিভিন্ন স্থানে তার সঙ্গীদের মাজারও রয়েছে। তার সহযাত্রী হিসেবে ১২০ জন অলি ছিলেন। সারাজীবন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে এ সুফি-দরবেশ এ অঞ্চলে অমর হয়ে আছেন। প্রতি বছর ফাল্কগ্দুন মাসে সপ্তাহব্যাপী তার মাজারে ওরস পালিত হয় আর তাতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লাখ লাখ লোকের সমাগম ঘটে।
ঐতিহাসিকদের মতে এটিই ইসলাম প্রচারে আগত প্রথম মিশন। তিনি উপমহাদেশের বহু অঞ্চল অতিক্রম করে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, বগুড়া হয়ে পরিশেষে নেত্রকোণা থানার মদনপুরে আসেন। তখন বাংলায় চলছিল বৌদ্ধ ও সনাতন হিন্দুদের সংঘর্ষ। আবার হিন্দুদের বর্ণপ্রথাতেও ক্ষতবিক্ষত ছিল লোক সমাজ। এই জটিল মূহুর্তে ইসলামের সুফিবাদের বাণী আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় গোটা সমাজকে। তাই তিনি উদার-উদাস প্রকৃতির বিচিত্র প্রাকৃতিক শোভার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন ইসলামের বাণী, শান্তির চেতনা। সে চেতনার সারমর্ম ছিল মানবপ্রেমের রসসিক্ত সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ। এ কালজয়ী পুরুষের সমাধিস্থলে আজ জড়ো হয় লাখ লাখ মানুষ। ফলে এ মাজারটি পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের তথা বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়। মাজারটির অবস্থান নেত্রকোণা-কেন্দুয়া সড়কের মধ্যবর্তী স্থানে মদনপুর নামক গ্রামে।
কিভাবে যাওয়া যায়:
নেত্রকোণা সদর বাস টার্মিনাল থেকে বাস, হোন্ডা, অটোরিক্সা, রিক্সা করে মদনপুর ইউনিয়নে অবস্থিত এ ঐতিহাসিক স্থাপনাতে যাওয়া যায়।