কাজী আরেফ আহমেদ (জন্ম- ৮ই এপ্রিল ১৯৪২ , মৃত্যু- ১৬ই ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯) কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ঝাউদিয়া গ্রামে জন্ম। ১৯৬২ এর নিউক্লিয়াসের সদস্য ও মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি ।পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টরে মুজিব বাহিনীর ডিপুটি প্রধান হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন কাজী আরেফ, মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রূপকার।
কাজী আরেফ আহমেদ: ১৯৭১এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মুজিব বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টরের ডিপুটি প্রধান ছিলেন।
কাজী আরেফের জন্ম ১৯৪২ সালের ৮ এপ্রিল জন্ম নানার বাড়ি সদর উপজেলার ঝাউদিয়া গ্রামে এবং পৈতৃক সূত্রে ঠিকানা মীরপুর উপজেলার খয়েরপুর গ্রাম।
- ১৯৬৬ সনে ছয় দফা আন্দোলনকে জনপ্রিয় করতে তিনি সাহসী ভূমিকা পালন করেন।
- ১৯৭২ সনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদে)-এর উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন ছিলেন।
- জাতীয় কৃষক লীগের সভাপতি ছিলেন।
- স্বাধীনতার পর জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ‘গণকণ্ঠ’-এর প্রধান কার্যনির্বাহী ছিলেন।
- মীরপুর মুক্তিযোদ্ধা গোরস্থানে অন্তীম শয়নে কাজী আরেফ আহমেদ
"ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম ঘোষনা করে ইসলামের মান বাড়েনি বরং ইসলামের মহাত্বকে খাটো করা হয়েছে। ইসলাম উদারতার ধর্ম, ইসলামে সব মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। কোরান ও সুন্নার কোথাও খৃষ্টান বৌদ্ধ বা হিন্দু ধর্মকে উপেক্ষা করেনি। ইসলামে সকল ধর্মের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা হয়েছে।"(সাপ্তাহিক এখনই সময়)
----কাজী আরেফ আহমেদ
জাতিয় সমন্বয় কমিটির আজকের আন্দোলনের লক্ষ্য শোষনমুক্ত অসাম্প্রদায়িক গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং ৭১ এর যুদ্ধাপরাধী ঘাতক গোলাম আযম , আব্বাস আলী , নিজামী , কামারুজ্জামান , আলীম , মাওলানা মান্নান এবং আনোয়ার জাহিদদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করবো। এ লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের ২য় পর্ব শুরু হয়েছে জাতীয় সমন্বয় কমিটির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
---- কাজী আরেফ আহমেদ।
মন্তব্য : ১৬/০২/১৯৯৩ সালে আজ থেকে প্রায় ২২ বছর আগে কাজী আরেফ আহমেদ যা ভেবেছিলেন তা আজ বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাত: সাংবাদিক, নব্বইয়ের গণ আন্দোলনের কেন্দ্রিয় ছাত্র সংগঠক, কাজী আরেফ আহমেদ এর সহকর্মী বলেছেনঃ
কাজী আরেফ কেবল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না, বাংলাদেশের আত্মার খবরও রাখতেন। তাই তাকে বাংলাদেশের আত্মা বলে জানতেন রাজনৈতিক সহযোদ্ধারা। বাঙালি জাতিসত্ত্বার হাজার বছরের ইতিহাসকে পরিপূর্ণ রূপ দেয়ার জন্য যারা স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বপ্নবাজ তারুণ্যের অগ্রগণ্য একজন ছিলেন তিনি। ১৯৪২ সালের ৮ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার সদর উপজেলার ঝাউদিয়া ইউনিয়নের নানাবাড়িতে জন্ম তাঁর। পৈত্রিক বাড়ি ছিলো কুষ্টিয়ার মীরপুর উপজেলার খয়েরপুর গ্রামের বিখ্যাত কাজী বাড়ি। বাবা কাজী আবদুল কুদ্দুস মা খোদেজা খাতুন। ১০ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। ১৯৪৮ সালে বাবার সাথে সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। বসত গড়েন পুরাতন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী টিকাটুলী এলাকায়। ঢাকার নামকরা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৬০ সালে মেট্রিক, জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ১৯৬৬ সালে বিএসসি পাশ করেন।
এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে। রাজনীতির কারণে সরকারের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর ভর্তি বাতিল করে দেয় ১৯৬৬ সালে। স্কুল জীবন থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবোধের চিন্তা-চেতনার উন্মেষ ঘটে কাজী আরেফের মাঝে। ১৯৬০ সালে আইয়ুব শাহীর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগ কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য ও ১৯৬৩ সালে ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। তখন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন কেএম ওবায়দুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খান (দাদা ভাই)। ৬২ সাল থেকেই তিনি বাংলার স্বাধীনতা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি তথা বাঙালির জাতিরাস্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করেন। এ নিয়ে সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাকের সাথে নিয়মিত শলাপরামর্শ শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৬৪ সালে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের তিন সদস্য বিশিষ্ট নিউক্লিয়াস গঠিত হয়।
নিউক্লিয়াসের সদস্যরা হলেন, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমদ। এই নিউক্লিয়াস ছিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্তে ৬৪ সাল থেকে কাজী আরেফের পৈত্রিক নিবাস পুরাতন ঢাকার ১৪/৩ অভয় দাশ লেনের বাড়িতে নিজের হাতে লেখা ‘জয়বাংলা’ ‘বিপ্লবী বাংলা’ বিভিন্ন নামে স্বাধীনতার ইশতেহার সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ছাপানো হতো। কর্মীরা ওইসব পত্রিকা পড়ে পরে পুড়িয়ে ফেলতো নেতাদের পরামর্শে। আবদুর রাজ্জাকের দায়িত্ব ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগের। কাজী আরেফের দায়িত্ব ছিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সংগঠন গড়ে তোলা। শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন ছিল বিপ্লবী পরিষদের সকল কর্মকান্ডে। ৬২ এর ছাত্র আন্দোলন, ৬৬ এর ছয় দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর সাধারণ নির্বাচন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষনা, শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু উপাধি, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরী, আনুষ্ঠানিক পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ সর্বোপরি বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ ওই সবকিছুই ছিলো স্বাধীনতা বাংলা বিপ্লবী পরিষদের দুদীর্ঘ পরিকল্পনারই অংশ। আর ওইসব কিছুই পরিকল্পনা করতেন ৩ সদস্যের নিউক্লিয়াস। স্বাধীনতা সংগ্রামের নীতি কৌশল প্রনয়ন হতো নিউক্লিয়াস থেকেই।
কাজী আরেফ ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক জাতীয় পতাকারও অন্যতম রূপকার। তিনি ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমানে জহুরুল হক হল) ১১৮ নং কক্ষে বিপ্লবী পরিষদের সদস্যদের সাথে বাংলাদেশের পতাকার নকশা চূড়ান্ত করেন। নিউক্লিয়াসের সদস্য হিসেবে তিনি তাতে নেতৃত্ব দেন। তৈরি করা ওই পতাকা ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় উত্তোলন করেন ঢাকসুর ভিপি আ,স,ম আব্দুর রব। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার লক্ষ্য নিয়ে একদল তরুণ ৭২ সালের ৩১ অক্টোবর গঠন করেন জাসদ। কাজী আরেফ ছিলেন জাসদ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা। তিনি সে সময়ে দলের মুখপাত্র সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র দৈনিক গণকন্ঠের সম্পাদকের দায়িত্বও গ্রহন করেন।
তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধেরও একজন শীর্ষ পর্যায়ের সংগঠক। তিনি বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) তথা মুজিব বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টরের ডেপুটি প্রধানের পাশাপাশি মুজিব বাহিনীর ৪ আঞ্চলিক প্রধান শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ এর মধ্যে সমন্বয়কের দায়িত্বও পালন করেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল সংগঠন ও ব্যক্তিকে একটি প্লাটফর্মে নিয়ে আসার মূখ্য সংগঠকও ছিলেন তিনি। ১৯৯০ সালে ঐতিহাসিক ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম রূপকার কাজী আরেফ ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল দৃষ্টান্ত। তার মত সৎ, নির্ভীক, দৃঢ়চেতা, আদর্শবান রাজনীতিক আজকের যুগে বিরল। তিনি ছিলেন নির্লোভ এবং নির্মোহ।
আমার কাছ থেকে দেখা আরেফ ভাই নি:শব্দে কাজ করতেন। খানিকটা নেপথ্যচারি বলা যায়। তাঁর চলাফেরায় জীবনযাপনে কোথাও পরির্তন দেখিনি। একই ধরণের প্যান্ট-শার্ট পরতেন। হাটতেন, রিকসায় চড়তেন। সাধারণ বাসে যাতায়াত করতেন। অতি সাধারণ জীবন। সততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এক মহীরুহ রাজনীতিক।
বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের এই স্বপ্নপুরুষের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি বিশ্বের অনেক মহান জাতীয় বীরের মতো। আমাদের কালের রাজনীতির বরপুত্র জাতীয় বীর কাজী আরেফ আহমেদ ১৯৯৯ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার কালিদাসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে এক সন্ত্রাস বিরোধী জনসভায় বক্তব্যরত অবস্থায় সন্ত্রাসী ঘাতকদের ব্রাশফায়ারে নিহত হন। পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর মরদেহ সমাহিত করা হয় রাজধানীর মীরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। তিনি রেখে যান তাঁর এক সময়ের রাজনৈতিক সহকর্মী, সহধর্মিনী রওশন জাহান সাথী (নবম জাতীয় সংসদের সদস্য), একমাত্র পুত্র অরূপ ও একমাত্র কন্যা জুলিসহ লাখো লাখো সহযোদ্ধা ও সহকর্মী।
লাল সবুজের পতাকা যতোদিন উড্ডয়ন থাকবে ততোদিন কাজী আরেফও বেঁচে থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে। সবশেষে মাওসেতুং এর ভাষায় বলতে চাই-কাজী আরেফের মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী।