রবীন্দ্র সঙ্গীত হল বিশিষ্ট বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ও সুরারোপিত গান। বাংলা সংগীতের জগতে এই গানগুলি এক বিশেষ স্থানের অধিকারী। রবীন্দ্রনাথের জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ও আমার সোনার বাংলা গানদুটি যথাক্রমে ভারতীয় প্রজাতন্ত্র ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। ভারতের জাতীয় স্তোত্র বন্দে মাতরম্ রবীন্দ্রনাথেরই সুরারোপিত।
রবীন্দ্রনাথ রচিত মোট গানের সংখ্যা ১৯১৫।রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীতে উপনিষদ্, হিন্দু পুরাণ ও সংস্কৃত কাব্যনাটক, বৈষ্ণব ও বাউল দর্শনের প্রভাব সুস্পষ্ট। সুরের দিক থেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত (হিন্দুস্তানি ও কর্ণাটকী উভয় প্রকারই), বাংলা লোকসংগীত, কীর্তন ও রামপ্রসাদী এবং পাশ্চাত্য ধ্রুপদি ও লোকসংগীতের "ত্রিবেণীসংগম" ঘটেছে রবীন্দ্রসংগীতে। রবীন্দ্রনাথের সমুদয় গান তাঁর গীতবিতান গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। উক্ত গ্রন্থের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে কবি গানগুলিকে "পূজা", "স্বদেশ", "প্রেম", "প্রকৃতি", "বিচিত্র" "আনুষ্ঠানিক", এই ছয়টি "পর্যায়ে" বিন্যস্ত করেছিলেন। কবির প্রয়াণের পর প্রথম দুটি খণ্ডে অগ্রন্থিত গানগুলি নিয়ে গীতবিতান সংকলনের তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। এই খণ্ডে গানগুলি "গীতিনাট্য", "নৃত্যনাট্য", "ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী", "নাট্যগীতি", "জাতীয় সংগীত", "পূজা ও প্রার্থনা", "আনুষ্ঠানিক", "প্রেম ও প্রকৃতি" ইত্যাদি পর্বে বিন্যস্ত হয়।৬৪ খণ্ডে প্রকাশিত স্বরবিতান গ্রন্থে তাঁর সমুদয় গানের স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের পরিবারে সংগীতের চর্চা ছিল মজ্জাগত। পিতা দেবেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের দাদারা নিয়মিত সংগীতচর্চা করতেন। তবে কিশোর রবীন্দ্রনাথের সংগীতশিক্ষায় সর্বাধিক প্রভাব ছিল তাঁর "নতুনদাদা" জ্যোতিরিন্দ্রনাথের।তেরো বছর বয়সে লেখা "গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে" গানটি সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের প্রথম রচিত গান। এরপর প্রায় সত্তর বছর ধরে তিনি অবিশ্রাম গীতিরচনা করেন। স্বরচিত গান ছাড়াও সুরারোপ করেন বৈদিক স্তোত্র, বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস ও অন্যান্যদের রচনায়। তাঁর শেষ গান "হে নূতন দেখা দিক আর-বার" ১৯৪১ সালে কবি তাঁর জীবনের শেষ জন্মদিন উপলক্ষ্যে রচনা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ নিজেও ছিলেন সুগায়ক। বিভিন্ন সভা-সমিতিতে তিনি স্বরচিত গান গেয়ে শোনাতেন। কয়েকটি গান গ্রামাফোন ডিস্কে রেকর্ডও করেছিলেন। সংগীত প্রসঙ্গে একাধিক প্রবন্ধও রচনা করেছিলেন কবি। সংগীতকে তিনি বিদ্যালয়-শিক্ষার পরিপূরক এক বিদ্যা মনে করতেন।রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাঁর গানগুলি বাঙালি সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
"রবীন্দ্র সঙ্গীত" বলতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কর্তৃক রচিত এবং রবীন্দ্রনাথ অথবা তাঁর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর-কর্তৃক সুরারোপিত গানগুলিকেই বোঝায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় অন্যের সুরারোপিত গানগুলিকে রবীন্দ্র সঙ্গীত হিসেবে ধরা হয় না।